বায়ুদূষণে বিষণ্নতায় ভুগছেন রাজধানীর ৭১% মানুষ
প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
কয়েক বছর ধরে বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে ঢাকা। বায়ুদূষণের কারণে ক্যানসারসহ শ্বাসযন্ত্রের নানা রোগব্যাধী বাড়ছে। এছাড়া সারাদেশে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় পাঁচ বছর চার মাস আর রাজধানী ঢাকায় কমেছে ৭ বছর ৭ মাস। বায়ুদূষণে দেশে বছরে প্রায় ২৪ হাজার মানুষের মৃতু্য হচ্ছে, আর শিশুমৃতু্যর হারে বিশ্বে সর্বোচ্চ বাংলাদেশ। মানুষের মৃতু্যর ক্ষেত্রে চতুর্থ প্রধান কারণ এখন বায়ুদূষণ। শিশুদের অ্যাজমা বেড়ে যাচ্ছে, অসুস্থ বাচ্চার জন্ম হচ্ছে। আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বায়ুদূষণে রাজধানীর ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন।
কয়েক বছর ধরে রাজধানী ঢাকা বায়ুদুষণে বিশ্বে শীর্ষ ১০ দেশের মধ্যে অবস্থান করছে। এর মধ্যে ভরা বর্ষার দিনগুলোতেও দূষণে প্রথম থাকে ঢাকা। ফুসফুস ও হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়া মানুষের সংখ্যা বাড়ছে শ্বাসকষ্ট, অ্যালার্জি, চুলকানিসহ চর্মরোগের প্রকোপ বাড়ছে। নগরে বায়ুদূষণ ঠেকাতে পারেনি ৮ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প। পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট) প্রকল্পের গবেষণায় এমন তথ্য এসেছে।
রাজধানীর পুরান ঢাকার আশেপাশের এলাকায় দূষণ সবচেয়ে বেশি। এরপর আবাসিক এলাকা ধানমন্ডি, গুলশান, বাড্ডা ও বনানীতে দূষণের মাত্রা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। সবচেয়ে বেশি দূষিত এলাকা হচ্ছে এখন বারিধারা-আমেরিকান অ্যাম্বেসির কাছাকাছি এলাকা। এ ছাড়াও মিরপুর, আগারগাঁও, গাবতলী, উত্তরা, এয়ারপোর্ট, মহাখালী, বিজয়নগর, মতিঝিল ও গুলিস্তানে দূষণ দিনের পর দিন বাড়ছে। ঢাকার বাইরে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে- খুলনা, রাজশাহী, যশোর, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, নরসিংদী, পাবনা ও গাজীপুর।
এদিতে বায়ুদূষণের কারণে মানবদেহে কাজ করছে না অ্যান্টিবায়োটিক। এতে বাড়ছে নানা রোগব্যাধি। শুধু বাংলাদেশই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও বায়ুদূষণের কারণে বাড়ছে রোগব্যাধি।
বাংলাদেশের ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল
\হএনভায়রনমেন্ট প্রকল্পের সাবেক পরিচালক ডক্টর মঞ্জুরুল হান্নান খান বলেন, বিশ্বব্যংকের এক গবেষণায় দেখা যায়, বায়ুদূষণের কারণে রাজধানী ঢাকার ৭১ শতাংশ মানুষ বিষণ্নতায় ভুগছেন। বায়ুদূষণজনিত ক্যানসারসহ শ্বাসযন্ত্রের নানা রোগব্যাধী বাড়ছে। দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি হয় এবং স্নায়ুগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। দূষিত হওয়ার কারণে অনেকের মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। যার ফলে ফুসফুসে ও হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। বায়ুদূষণের কারণে মানুষের শরীরে নানা রোগবালাই যেমন বাসা বাঁধছে, তেমনি মনের মধ্যেও নানা ধরনের রোগশোকের জন্ম দিচ্ছে।
বায়ুদূষণ রোধে পরামর্শ : বায়ুদূষণ থকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য মাস্ক বা মুখোশ পরতে পারেন। বাসা থেকে বিনা কারণে বের হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারেন। বাসার দরজা-জানালা বন্ধ রাখতে পারেন। ধূমপান বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। কীটনাশক ব্যবহার পরিহার করতে হবে। পোকা দমনের জন্য কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে তা মাটি, বায়ু ও পানিকে দূষিত করছে। কমাতে হবে পস্নাস্টিকের ব্যবহার। পরিকল্পিতভাবে শহরের কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমিয়ে আনতে হবে। অথবা কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যেতে হবে। রাজধানীতে ট্রাফিক জ্যাম কমাতে হবে। উন্নতমানের জ্বালানি ব্যবহার করা বাড়াতে হবে এবং এয়ার কন্ডিশনার কম ব্যবহার করতে হবে। আবাসিক এলাকাগুলো পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা, যেখানে গাছের বাগান ও পুকুর থাকবে। নির্মাণ কাজগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে ঢেকে করতে হবে, যাতে সেটি দূষণের কারণ না হয়।
দূষণ ঠেকাতে স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব (সিটি করপোরেশন-১) মোহাম্মদ সামসুল ইসলামের স্বাক্ষর করা চিঠিতে বলা হয়েছে, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার আওতাধীন পরিচালিত নির্মাণকাজের সময় ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে পানি ছিটানো, নির্মাণসামগ্রী ঢেকে পরিবহণ ও মজুত করা এবং প্রযোজ্য ক্ষেত্রে ধূলিদূষণ নিয়ন্ত্রণে উপযুক্ত বেষ্টনীর ব্যবহার করতে হবে। রাস্তা বা ড্রেন থেকে বর্জ্য তুলে উন্মুক্তভাবে ফেলে না রেখে দ্রম্নত পরিবহণের ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তার উন্নয়নকাজ যথাসম্ভব রাত্রিকালীন সম্পন্ন করা ও নির্ধারিত স্থানটি বেষ্টিত রেখে দৈনিক একাধিকবার পানি ছিটানোর নির্দেশনাও দেওয়া হয়।
এ বিষয়ে পরিবেশবিদ সমর কুমার চন্দ্র বলেন, ঢাকায় রাস্তা নির্মাণের কাজ, কল-কারখানার ধোঁয়া, গাড়ির কালো ধোঁয়া, ধূমপান, যেখানে সেখানে কাগজ, নোংড়া মফলা পুড়িয়ে ফেলার কারণে বায়ুদূষণ হচ্ছে, এটা বন্ধ করতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে শিল্পাঞ্চলের কারখানা থেকে নির্গত কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, হাইড্রোকার্বন, ধাতব কণা, ধোঁয়া প্রভৃতি ব্যাপক পরিমাণে বাতাসে মিশ্রিত হয়ে বাতাসকে দূষিত করে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম প্রধান বায়ুদূষক কার্বন মনোক্সাইডের প্রায় ৭০ শতাংশ এই যানবাহন থেকে নির্গত হয়। এছাড়া যানবাহনের ধোঁয়ায় প্রচুর নাইট্রোজেনের অক্সাইড থাকে যা বায়ুকে দূষিত করে তোলে নগর। যানবাহনের আধিক্যের জন্য শহরাঞ্চলের বাতাস বেশি দূষিত হয়।
নগরপরিকল্পনাবিদ ডক্টর শমসের আলী বলেন, পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো সাধারণত জলাশয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে শহর, হাট-বাজার, বাসাবাড়ির ময়লা-আবর্জনা, বিভিন্ন প্রাণীর মলমূত্র, খাল, বিল ও নদীতে পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে। প্রতিটি শিল্পকারখানার সঙ্গে ইটিপি স্থাপন বাধ্যতামূলক করতে হবে। এছাড়াও বাড়ির ময়লা আবর্জনা পানিতে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে। এতে পানি ও বায়ু দুটোই দূষণ রোধ হবে।
আবহাওয়াবিদ ডক্টর শাহিনুর রহমান বলেন, বায়ুদূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হলো ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল, ইটভাটা, রাস্তায় যত্রতত্র খোঁড়াখুঁড়ি, শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্য, অপরিকল্পিতভাবে শিল্পকারখানা গড়ে ওঠা, ঢাকার মতো বড় শহরের চারপাশে ইটভাটা, শহরের মধ্যে নানা কারখানা স্থাপন বায়ু দূষণের একটি কারণ। সেই সঙ্গে শহরের প্রচুর ধুলা এবং নির্মাণ কাজের বায়ুদূষণ হচ্ছে। বায়ুদূষণ কমানো গেলে একদিকে যেমন মানুষের অসুস্থতা কমবে, গড় আয়ু বাড়বে, সময় সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি বেড়ে যাবে জিডিপিও।
বারডেমের পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ড. শারমিনা নাসরিন বলেন, বায়ুদূষণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঠেকাতে সহায়তা করে ভিটামিন সি। ভিটামিন সি উৎকৃষ্ট অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। এটি ক্যানসার প্রতিরোধ করে ও ক্যানসার সৃষ্টিকারী ভাইরাসকেও কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে পারে। লেবু, আমলকী, পেয়ারা, জাম্বুরা, আনারস, আমড়া, আম, আঙুর, কাঁচা মরিচ, জলপাই, বরই, কামরাঙা, টমেটো, বাঁধাকপি, কমলালেবু ইত্যাদি ভিটামিন সি'র গুরুত্বপূর্ণ উৎস।