হোটেল-রেস্টুরেন্টে অভিযান
অভিযান ঘিরে চোর-পুলিশ খেলা!
প্রকাশ | ০৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
রাজধানী ঢাকার ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ হোটেল-রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার সকালে সিটি করপোরেশন, রাজউক, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সাঁড়াশি অভিযানে নামার পর আতঙ্কিত মালিক-কর্মচারীরা তাড়াহুড়ো করে অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। ফলে সাজসাজ প্রস্তুতি নিয়ে মাঠে নেমেও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তেমন কোথাও বড় ধরনের কোনো অভিযান চালাতে পারেনি। তবে বিকালের দিকে অভিযান শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঢাকার অধিকাংশ রেস্তোরাঁ খুলতে শুরু করে। সন্ধ্যার পর ধানমন্ডি, গুলশান ও বনানীসহ ঢাকার সব রেস্তোরাঁ অনেকটা আগের মতো জমজমাট হয়ে ওঠে।
বুধবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যেসব রেস্টুরেন্টে সকালে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা হয়েছে, সেগুলো ছাড়া প্রায় সব রেস্টুরেন্টেই ধুমছে ব্যবসা চালাচ্ছে। বেইলি রোডের অগ্নিকান্ডের আতঙ্ক কাটিয়ে অনেকেই বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেখানে খেতে এসেছে। কোথাও দেখে বোঝার উপায় নেই, কয়েক ঘণ্টা আগেই এসব রেস্তোরাঁ পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
একই ধরনের দৃশ্য দেখা গেছে, গুলশান, বনানী, মিরপুর ও উত্তরাসহ সবখানেই। সারাদিন বন্ধ রাখার পর সন্ধ্যায় প্রতিটি রেস্তোরাঁতেই দেখা গেছে আগের মতোই উপচেপড়া ভিড়। গুলশানের একটি অভিজাত রেস্তোরাঁর মালিক জহির উদ্দিন নান্নু জানান, সিটি করপোরেশন, রাজউক ও ফায়ার সার্ভিসের অভিযানের ভয়ে সকালে তারা রেস্তোরাঁ বন্ধ রেখেছিলেন। কিন্তু বিকাল ৫টার পর যেহেতু এসব প্রতিষ্ঠান অভিযান চালায় না তাই তারা হোটেল-রেস্টুরেন্ট খুলে বসেছে।
ওই রেস্তোরাঁ মালিকের ভাষ্য, বৃহস্পতিবার সকালেও তারা রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখবেন। তবে পরিস্থিতি বুঝে বিকালের পর রেস্টুরেন্ট খোলা রাখবেন কিনা সে ব্যাপারে সবাই বুদ্ধি-পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেবেন।
গুলশানের একটি খ্যাতনামা কফি শপের মালিক বলেন, 'এভাবে 'চোর-পুলিশ খেলা' তাদেরও ভালো লাগে না। কিন্তু তারা নিরুপায়। কেননা রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে ঘরে বসে থাকলেও মাস শেষে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ভাড়া, বিদু্যৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিল ও ভ্যাট-ট্যাক্স ঠিকই দিতে হবে। এ ছাড়া রেস্তোরাঁর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন তো রয়েছেই। তাই তারা আপাতত সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও রাজউকের অভিযান পাশ কাটিয়েই ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এভাবে বেশিদিন ব্যবসা চালানো যাবে না তা তারা ধরেই নিয়েছেন।
হোটেল মালিক
সমিতির নেতারা জানান, তাদের সংশোধনের কোনো সুযোগ না দিয়ে এভাবে অভিযান অব্যাহত রাখা হলে তারা একযোগে সব রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। কেননা এভাবে সন্ধ্যার পর কয়েক ঘণ্টা রেস্তোরাঁ চালু রেখে তারা ব্যবসার খরচ তুলতে পারবেন না। উল্টো এতে তাদের লোকসানের পালস্নাই ভারী হবে।
এদিকে খিলগাঁও, ধানমন্ডি ও গুলশান এলাকার বেশ কয়েকজন রেস্তোরাঁ মালিকের সঙ্গে কথা বলে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তারা জানান, কখন কোন এলাকার রেস্তোরাঁয় কারা অভিযান চালাবে তার আগাম তথ্য পেতে ফায়ার সার্ভিস, রাজউক ও সিটি করপোরেশনে তারা নিজস্ব সোর্স নিয়োগ করেছেন। ভ্রাম্যমাণ আদালত টিম নিয়ে রওনা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা তা রেস্টুরেন্ট মালিক-কর্মকর্তাদের জানিয়ে দিচ্ছেন। অভিযানের আগাম তথ্য পেতে তারা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছেন। এ ছাড়া ওইসব প্রতিষ্ঠানের যেসব কর্মকর্তা তাদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা নেন তারাও তাদের অভিযানের ব্যাপারে আগাম তথ্য জানিয়ে দিচ্ছেন।
ধানমন্ডির একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের এক ব্যবস্থাপক এ প্রতিবেদককে জানান, হোটেল-রেস্টুরেন্ট দেখভালের দায়িত্বে থাকা সব প্রতিষ্ঠানেরই একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা তাদের কাছ থেকে নিয়মিত উৎকোচ নেন। এ ছাড়া ভ্যাট কর্মকর্তাদেরও তারা মোটা অংকের মাসোহারা দেন। বিনিময়ে তারা বেশ খানিকটা কম ভ্যাট নির্ধারণ করেন।
ওই ব্যবস্থাপকের দাবি, তারা গ্রাহকের কাছ থেকে যে ভ্যাট আদায় করেন, এর প্রায় সবটাই খরচ হয়ে যায়। তবে ভ্যাট কর্মকর্তাদের উৎকোচ না দিয়ে পুরো টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়ার সুযোগ কম। কেননা তাদের ঘুষ না দিলে মোটা অংকের রাজস্ব জমা দিলেও তারা নানা আইনি মারপঁ্যাচে তাদের ফাঁসিয়ে দেন।
রেস্টুরেন্ট মালিকদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন, ফায়ার ও রাজউকের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের নিয়মিত মাসোহারা না দিয়ে তারা অনায়াসেই প্রয়োজনীয় সব লাইসেন্স নিয়ে ঝুঁকিবিহীনভাবে ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন। তবে এজন্য বর্তমান সিস্টেমের পরিবর্তন আনতে হবে। তাদের সুযোগ না দিয়ে টানা অভিযান চালালে প্রকৃত অর্থে কাজের কাজ কিছুই হবে না বলে মনে করেন তারা।
এদিকে বুধবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রাজউক ও সিটি করপোরেশনের চলমান অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারাও অভিযান ঘিরে 'চোর-পুলিশ খেলা' চলার কথা পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, মঙ্গলবার দিনভর বিভিন্ন এলাকার রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে তারা আশানুরূপ কিছু করতে পারেননি। কেননা তাদের অভিযানের খবর পেয়ে প্রায় সব হোটেল-রেস্টুরেন্টই দ্রম্নত বন্ধ করে দিয়ে মালিক-কর্মচারীরা সটকে পড়েন। তবে বিকালের পর বিপুলসংখ্যক রেস্টুরেন্ট খোলা হয়েছে বলে তারা খবর পেয়েছেন।
এভাবে অভিযান চালিয়ে মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন হবে বলে মনে করেন খোদ অভিযানে অংশগ্রহণকারীরা অনেকেই। তাদের ভাষ্য, হয়রানি করে হোটেল-রেস্টুরেন্ট বন্ধ করে দেওয়া তাদের টার্গেট নয়। সরকার শুধু ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করতে চাইছে। এজন্য পরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এলোমেলো অভিযান চালিয়ে এভাবে হোটেল-রেস্টুরেন্ট দিনে-রাতের অর্ধেক সময় বন্ধ রাখা হলে এ খাতে ভয়াবহ ধস নামতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
একই ধরনের মত দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবান ও রিজিওনাল পস্ন্যানিং বিভাগের অধ্যাপক পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, এখন বিচ্ছিন্ন কোনো অভিযান কাজে দেবে না। বরং সব সেবা সংস্থা একত্রিত হয়ে যদি অভিযান চালায় এবং অভিযানকালে কী কী জিনিস দেখবে তার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে অভিযানের মূল লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে।
তিনি আরও বলেন, রেস্তোরাঁ বা দোকান মালিকরা বিভিন্ন সংস্থা থেকে ছাড়পত্র নিয়েছে। কিন্তু সমন্বিতভাবে না দেওয়ায় সঙ্গতিপূর্ণ ছাড়পত্র হয়নি। সমন্বয়হীনতা বিষয়গুলো বারবার সামনে আসার পরও সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় না হওয়া হতাশাজনক।
এই পরিকল্পনাবিদের ভাষ্য, এখন অধিকাংশ অভিযান হয়ে গেছে মানুষকে হয়রানির হাতিয়ার। আমরা বারবার সমন্বয়হীনতার গল্প করি। সদিচ্ছা থাকলে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধি নিয়ে অভিযান করা যায়। এতে সরকারেরও অর্থের সাশ্রয় হয়, ভোগান্তিও কম হয়। এ বিষয়গুলো সব সেবা সংস্থাই জানে, কিন্তু সমন্বয় করতে কোনো সংস্থাই আগ্রহী না। এত বড় ঘটনার পর কেন সমন্বিত অভিযান হবে না, তা একটি বড় প্রশ্ন।
নগর বিশেষজ্ঞ ও রাজউকের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মো. এমদাদুল ইসলাম বলেন, রাজধানীতে ভবনের নকশার অনুমোদন দিয়েছে রাজউক, সেখানে ব্যবসা করার লাইসেন্স দিয়েছে সিটি করপোরেশন। দুর্ঘটনার পর রাজউক অভিযান চালাচ্ছে একভাবে, সিটি করপোরেশন আরেকভাবে, পুলিশ চালাচ্ছে তাদের মতো করে। সংস্থাগুলোর অভিযান চলছে আলাদা। এখন যে অভিযান চলছে তাতে যদি সমন্বয় থাকত, তাহলে ভালো ফল পাওয়া যেত।
দীর্ঘ মেয়াদে সুফল পেতে সমন্বিত অভিযানের ওপর গুরুত্ব দেন এ নগর বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেন, রাজউক বেইলি রোডে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছে। যাদের দোকান-রেস্তোরাঁ বন্ধ করা হয়েছে তারা আদালতে যাবেন। আদালতে রাজউকের আইনজীবীরা লড়াই করবেন। আদালতে ফায়ারের সমস্যা, সিটি করপোরেশন সমস্যার বিষয়ে কোনো তথ্য উপস্থাপন করার কোনো আইনজীবী থাকে না। যদি রাজউক, সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশ একসঙ্গে তালিকা ধরে অভিযান চালিয়ে দোকান-রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেয়, তখন সংশ্লিষ্ট দোকান- রেস্তোরাঁ মালিক আদালতে গেলে সব সংস্থার আইনজীবীরা আদালতে তাদের পক্ষে মতামত তুলে ধরবেন। সব সংস্থার আইনজীবীরা তাদের ঝুঁকিসংক্রান্ত মতামত দিলে আদালত সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে সহসা অনুমতি দেবে না। এ কারণে অভিযানগুলো সমন্বয় করে চালানো উচিত। তবে এখন যে অভিযান চলছে এটা লোক দেখানো। অগ্নিকান্ডের পর সাধারণ মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ দেখা গেছে, তা সামাল দেওয়ার একটি কৌশল হচ্ছে এ অভিযান- যোগ করেন তিনি।