১৯৭১ সালের ৬ মার্চ ছিল সভা-সমাবেশ-মিছিলে উত্তাল একটি দিন। টানা হরতালের মধ্যে এদিন মহিলা আওয়ামী লীগের আয়োজনে বিশাল মিছিল, অলি আহাদের নেতৃত্বে পল্টনে জনসভা এবং মোজাফফর আহমেদের সভাপতিত্বে হয় গণসমাবেশ। এর মধ্যে প্রদেশে প্রথমবারের মতো ঘটে কারা বিদ্রোহের ঘটনা।
এদিন বেলা ১১টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ভেঙে বেরিয়ে আসে ৩৪১ কয়েদি। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার সময় প্রহরীদের গুলিতে নিহত হন সাত কয়েদি। আহত হন ৩০ জন। এ ছাড়াও খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন ১৮ জন এবং আহত হন ৮৬ জন।
অন্যদিকে অসহযোগ চলতে থাকে পুরোদমে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শান্তিপূর্ণ হরতাল পালন শেষে তারই নির্দেশে বেলা আড়াইটা থেকে বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক এবং যেসব বেসরকারি অফিসে ইতোপূর্বে বেতন দেওয়া হয়নি- সেগুলো বেতন দেওয়ার জন্য খোলা থাকে।
দিন যতই গড়াচ্ছিল, অসহযোগ আন্দোলনের গন্তব্যও ততই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ আরও বেড়ে চলছিল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু কী ভাষণ দেবেন, তা শোনার জন্য সারাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল।
এরই মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ভাইস অ্যাডমিরাল এসএম আহসানকে অপসারিত করেন ইয়াহিয়া খান। তার স্থলে নতুন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানকে। জাহানারা ইমাম একাত্তরের দিনগুলি বইয়ে এ
দিনের বিবরণ দিয়েছেন এভাবে: 'আজ দুপুর একটা পাঁচ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। প্রেসিডেন্ট কী বলেন, তা শোনার জন্য সকলেই চনমন করছি। এক তারিখের ঘোষণায় তো লঙ্কাকান্ড বেঁধে গেছে। এখন আবার কী বলেন, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই। আগামীকাল রেসকোর্সের গণজমায়েতে শেখ কী বলবেন, তা নিয়েও লোকজনের জল্পনা-কল্পনার অবধি নেই।...এত মিছিল, মিটিং, প্রতিবাদ, কারফিউ ভঙ্গ, গুলিতে শয়ে শয়ে লোক নিহত। এর প্রেক্ষিতে শেখ আগামীকাল কী ঘোষণা দেবেন? কেউ বলছে, উনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। কেউ বলছে, তা কী করে হবে? উনি নির্বাচনে জিতে গণপ্রতিনিধি, মেজরিটি পার্টির লিডার, উনি এ দাবির জোরে সরকার গঠন করবেন, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করবেন। এখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে সেটা তো রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়ে পড়বে। কেউ বলছে, আগামীকালের মিটিংয়ের ব্যাপারে ভয় পেয়ে ইয়াহিয়া আজ ভাষণ দিচ্ছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে এক বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের বিক্ষুব্ধ জনসাধারণকে দুষ্কৃতকারী আখ্যা দেন। বেতার ভাষণে তিনি বলেন, 'রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে নিজেদের মধ্যে সমস্যার সমাধান করতে পারেনি। আমি আগামী ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতাদের বৈঠক আহ্বান করেছিলাম। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা এই বৈঠক প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাই আমি ২৫ মার্চ ঢাকা জাতীয় পরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশন আহ্বান করলাম।'
এদিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নির্বিচারে হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ও স্বাধিকার আন্দোলনের সমর্থনে এদিন রাস্তায় নেমে আসেন শিক্ষাবিদ, শিল্পী, কবি-সাহিত্যিক ও নারী-পুরুষসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ। ন্যাপ (মোজাফফর), ন্যাপ (ওয়ালী), পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টস, পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষক সমিতি, মহিলা সমিতি, শ্রমিক কৃষক, সমাজবাদী দলসহ অন্যান্য দল ও সংগঠনের নেতারা পৃথক বিবৃতিতে গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমর্থন জানান। জাতীয় লীগ নেতা অলি আহাদ স্বাধিকার আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি ঘোষণা করার জন্য জনসভা থেকে শেখ মুজিবের প্রতি আহ্বান জানান। ওদিকে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, আওয়ামী লীগের ছয় দফার ব্যাপারে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করতে আগ্রহী। পূর্ববাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এদিন মধ্যরাত পর্যন্ত দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও সমমনা বিভিন্ন দলের নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে ৭ মার্র্চের জনসভার প্রস্তুতি এবং পরবর্তী কর্মসূচি নির্ধারণের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করে দিকনির্দেশনা দেন।
এদিকে ৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেবেন, তা ঠিক করতে বঙ্গবন্ধু দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা করা হবে কিনা, সেটাই ছিল প্রশ্ন। তবে এদিন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ভেসে ওঠে প্রতিরোধের নির্দেশ। তিনি বলেন 'তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রম্নর মোকাবিলা করতে প্রস্তুত হও।'