জাতীয় পাট দিবস আজ

পাট নিয়ে সোনালি দিনের স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ

প্রকাশ | ০৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন
ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পাটজাত পণ্য ব্য সামগ্রী উৎপাদন ছিল একক বৃহত্তম শিল্প। তখন পাটকে সোনালি আঁশ বলা হতো। দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিল পাট পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত। রপ্তানি আয়ের শীর্ষ খাতও ছিল পাট। বাংলাদেশের গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে পাট উৎপন্ন হতো প্রায় তিন হাজার বছর আগে। স্বাধীনতার পর দেশের প্রধান অর্থকরী ফসল ছিল পাট। ১৯৯৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাংকের পাট খাত সংস্কার কর্মসূচির আওতায় পাট খাত ধ্বংস করা হয়। এরপর গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বে আবার পাটের রমরমা বাণিজ্য চলছে। বাংলার পাট আবার বিশ্ব মাতিয়ে চলেছে। সেই সোনালি দিনে ফেরার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ। যুদ্ধ বা দুর্ভিক্ষে বিধ্বস্ত দেশগুলোতে দাতা সংস্থার ত্রাণসামগ্রী ব্যবহারে পাটের দড়ি ও বস্তার চাহিদা বেড়েছে। উড়োজাহাজ থেকে পাটের বস্তার মধ্যে খাবারসামগ্রী নিচে ফেলা হচ্ছে। পাটের সুতা দিয়ে শাড়ি, পাঞ্জাবির কাপড়, টুপি, জিন্স ও গরম কাপড় তৈরি হচ্ছে। পাটখড়ি থেকে তৈরি হচ্ছে কম্পিউটার ও ফটোকপির মূল্যবান কালি। বিশ্বের ১৩৫টি দেশে ২৮২টি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়। এ ছাড়াও প্রায় ৫০ ধরনের পাটের কাপড় রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বে। বিশ্বখ্যাত বিলাসবহুল গাড়িতে ব্যবহার করা হচ্ছে পাট। উড়োজাহাজের ইন্টেরিয়রও তৈরি হচ্ছে পাট দিয়ে। পাট পাতার সু্যপ ও পাটের কফিন ইউরোপের দেশগুলোতে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। বিশ্বে পরিবেশবান্ধব প্রাকৃতিক এই তন্তু বহুমুখী ব্যবহার বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় বাঁধ ও নদী ভাঙন রোধে পাটের বস্তা ব্যবহার হচ্ছে। জুট ডাইভারসিফিকেশন প্রমোশন সেন্টার ২৮২টি বহুমুখী পাটপণ্য বিক্রি করছে। দেশে-বিদেশে পাটের রমরমা অবস্থা আবার ফিরেছে। পাট খাতের বৈশ্বিক রপ্তানি আয়ের ৭২ শতাংশ এখন বাংলাদেশের হাতে। পাটের সোনালি সময়ে আজ পালিত হচ্ছে জাতীয় পাট দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য হচ্ছে- 'বঙ্গবন্ধুর সোনার দেশ, স্মার্ট পাটশিল্পের বাংলাদেশ'। পাট খাতে অবদান রাখায় এ বছর ১১ জন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কার প্রদান করা হবে। এ ছাড়াও পাটসংশ্লিষ্ট অংশীজনদের শুভেচ্ছা স্মারক প্রদান করা হবে। আগামী ১৪ মার্চ (বৃহস্পতিবার) বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন পাট দিবসের মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে। ১৪ থেকে ১৬ মার্চ তিন দিনব্যাপী বহুমুখী পাটপণ্য প্রদর্শনী ও মেলা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেলার উদ্বোধন করবেন। রপ্তানি উন্নয়ন বু্যরা (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, বিগত ১২ বছরে ১ বিলিয়ন ডলারের বেশি পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি হয়েছে চারবার। প্রথমবার ২০১০-২০১১ অর্থবছরে ১১১.৪৯ কোটি ডলার রপ্তানি আয় হয়। দ্বিতীয়বার ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ১০৩.০৬ কোটি ডলার, তৃতীয়বার ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ১০২.৫৫ কোটি ডলার ও ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১১৬.১৪ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ ১১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার আয় করেছে। এর মধ্যে কাঁচা পাট রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ২১ কোটি ৬১ লাখ ৮০ হাজার ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয় হয় ৯১ কোটি ২০ লাখ ডলার। গত অর্থবছর থেকেই বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে চামড়াকে ছাড়িয়ে দ্বিতীয় স্থান দখল করে নিয়েছে পাট খাত। চলতি অর্থবছরে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি থেকে ১১৬ কোটি ৭০ লাখ আয় করার লক্ষ্য ধরেছে সরকার। ৮ মাসে অর্থাৎ জুলাই-ফেব্রম্নয়ারি সময়ের লক্ষ্য ধরা ছিল ৯৫ কোটি ৭২ লাখ ডলার। সেই লক্ষ্যের চেয়ে আয় বেড়েছে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। পাটে সুদিন ফেরাতে সরকার ইতিমধ্যে ৩৭ হাজার ৬৪৬ কোটি ৭৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প নিয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের পাট উৎপাদন উপযোগী ৪৬ জেলার ২৩০টি উপজেলায় উন্নতমানের উচ্চফলনশীল পাট উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে খরার কারণে কৃষকরা পাট জাগ দিতে পারছেন না। এ জন্য দেশের ২৮ জেলার ১০০টি উপজেলায় পাট পচন গ্রিন হাউজ করা হয়েছে। এ ছাড়াও উচ্চফলনশীল পাট বীজ উৎপাদনের জন্য দেশের ৩৬ জেলার ১৫০ উপজেলায় উন্নত পাট চাষ করা হচ্ছে। চলতি বছর সরকার পাট উৎপাদনে সাড়ে ৭ কোটি টাকার প্রণোদনা দিচ্ছে। এর আওতায় দেশের ৩ লাখ ৩৬ হাজার ৬০০ জন ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও মাঝারি কৃষক বিনামূল্যে পাটের বীজ পাবেন। এ বিষয়ে সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, বাংলাদেশি বিজ্ঞানী মাকসুদুল আলমের নেতৃত্বে ২০১০ সালে গবেষণা দল পাটের জীবনরহস্য (জিনোম সিকোয়েন্স) আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ। এর ফলে বাংলাদেশ উন্নত মানের পাট চাষ এবং বীজ উদ্ভাবন করতে সক্ষম হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে পাটের জন্ম রহস্য আবিষ্কারের ঘোষণা দেন। এরপর পাটের তিনটি জিনোম কোড পায় বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত মানের পাট উৎপাদিত হয় বাংলাদেশে। দেশে প্রায় ৫০ লাখের বেশি কৃষক পাট উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেশের প্রায় চার কোটি মানুষ পাট খাতের ওপর নিভর্রশীল। বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রজনন বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা কৃষিবিদ ড. মো. আল-মামুন বলেন, ১৯৯০-এর দশকে দেশে পাট হতো ১২ লাখ হেক্টর জমিতে। পাট শিল্প খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা ভালো ব্যবসা করলেও লোকসান গুনছে সরকারি পাটকল। লোকসান বৃত্ত থেকে বের হতে সরকারি পাট কলকে বেসরকারি খাতে লিজ দিচ্ছে সরকার। মহামারি করোনাকাল থেকে সরকারি ২৫টি পাটকল বন্ধ রয়েছে। এ বিষয়ে পুষ্টি বিশেষজ্ঞ ডা. আয়শা জামান বলেন, পাটের পাতা শাক ও সু্যপ হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। ভেষজ হিসেবে পাট পাতার ব্যবহার প্রাচীনকাল থেকেই। পাটশাক ব্যাপক পুষ্টিগুণ ও বিভিন্ন ঔষধিগুণে গুণান্বিত। শুকনো পাটপাতা গুঁড়ো করে পানির সঙ্গে মিশিয়ে রোগ মুক্তির জন্য এবং কাঁচাপাতা শাক হিসেবে বহুকাল থেকেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এছাড়া শুকনো পাট পাতার পানীয় 'চা' হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করা হয়েছে। পাট পাতার রস রক্ত পিত্তনাশক, বাত নিরোধক, ক্ষুধাবৃদ্ধি কারক, আমাশয়, উদারাময় ও অমস্ন রোগের মহৌষধ। সবজি মেস্তা উচ্চ পুষ্টি ও ঔষধি মানের জন্য বিখ্যাত যার একগুচ্ছ স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশেই সবজি মেস্তার বাণিজ্যিক চাষ করা হয়। এর আকর্ষণীয় রং, অনন্য টক স্বাদ এবং বহুমুখী ব্যবহার এটিকে বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করে তুলেছে। সবজি মেস্তা বা রোজেলার নির্যাস উচ্চ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, অ্যান্টি-প্রলিফারেশন, অ্যান্টি-কার্সিনোজেনিক, অ্যান্টি-হাইপার সেনসিটিভ হাইপারসেনসিটিভ, অ্যান্টি-হাইপার লিপিডিমিক, হেপাটো-প্রতিরক্ষামূলক, মূত্রবর্ধক এবং অন্যান্য অনেক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বলে প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে বাণিজ্যিকভাবে পাটপাতা রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। থাইল্যান্ড, চীন ও জাপানে এ সু্যপের বেশ কদর রয়েছে। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র পাট ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশিদ বলেন, কাঁচা পাটের পাশাপাশি জুট ইয়ার্ন, টুওয়াইন, চট ও বস্তার পর এবার বিশ্ব বাজারে পাটের কাপড়ের চাহিদা বেড়েছে। পাটের ২২ জাতের সুতা রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের ১৪ দেশে। পাটকাঠি থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা হচ্ছে উচ্চমূল্যের অ্যাক্টিভেটেড চারকোল। এই চারকোল দেশের বিভিন্ন কারখানায় ব্যবহার হচ্ছে ও বিদেশে রপ্তানি করা হচ্ছে, যা থেকে তৈরি হচ্ছে কার্বন পেপার, মোবাইল ফোনের ব্যাটারি, ওয়াটার পিউরিফিকেশন পস্ন্যান্ট, বিভিন্ন ধরনের প্রসাধনী পণ্য। পাটের চারকোল রপ্তানি হচ্ছে চীন, তাইওয়ান, ব্রাজিলসহ বিভিন্ন দেশে। পাট থেকে তৈরি চোখ ধাঁধানো শোপিস, চেয়ার, দরজা, ফুলদানি, শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ, সু্যট-প্যান্ট, চাদর, এমনকি ডেনিমও পাট থেকে তৈরি হচ্ছে। জুতা, স্যান্ডেল, বাসকেট আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে রপ্তানি হচ্ছে।