দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস ও মিনিবাস থেকে বছরে ১ হাজার ৫৯ কোটি টাকা চাঁদা আদায় হয়। আর এই চাঁদার ভাগ পায় দলীয় পরিচয়ধারী ব্যক্তি বা গোষ্ঠী, ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তা-কর্মচারী, মালিক-শ্রমিক সংগঠন ও পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা।
নিবন্ধন ও সনদ হালনাগাদ করতে ৫২ দশমিক ৯ শতাংশ যাত্রীবাহী বাস বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) ঘুষ দেয়। বাসপ্রতি মাসিক ১৭ হাজার ৬১৯ টাকা ঘুষ নিয়ম বহির্ভূতভাবে আদায় করে বিআরটিএ। এভাবে বছরে ৯০০ কোটি টাকা ঘুষ আদায় করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি।
মঙ্গলবার 'ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস পরিবহণ ব্যবসায় শুদ্ধাচার' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানায় ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবি কার্যালয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির গবেষক মুহা. নূরুজ্জামান ফারহাদ, ফারহানা রহমান ও মোহাম্মদ নূরে আলম এ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
২০২৩ সালের মে মাস
থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত ৩২টি জেলার বাস কর্মী, শ্রমিক, মালিক ও যাত্রীদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ গবেষণা চালানো হয়েছে। এতে ৩২ জেলার ৫১টি বাস টার্মিনাল পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। ৬৯৬ জন যাত্রী, ৭০১ জন বাসকর্মী ও ১৬৮ জন বাস মালিকের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে।
গবেষণায় উঠে এসেছে, দেশের বৃহৎ বাস কোম্পানির প্রায় ৯২ শতাংশ পরিচালনার সঙ্গে রাজনীতিবিদরা সম্পৃক্ত। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, যাত্রীদের ৬০ দশমিক ৫ শতাংশ অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ করেছেন। আন্তঃজেলা দূরপালস্নার বাসগুলোকে বার্ষিক এক হাজার ১৯ টাকা, সিটি সার্ভিসগুলোকে পাঁচ হাজার ৬৫৬ টাকা ও আন্তঃজেলা আঞ্চলিক বাসগুলোকে এক হাজার ১৩৩ টাকা ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশকে ঘুষ হিসেবে দিতে হয়। পাশাপাশি টার্মিনালে বাস রাখতে বাসপ্রতি দৈনিক ১০৫ টাকা চাঁদা দিতে হয়।
প্রতিবেদনে টিআইবি বলছে, দেশের পুরোপরিবহণ খাত কতিপয় কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। শুদ্ধাচারের ঘাটতি থাকায় শ্রমিকরা অবহেলিত ও যাত্রীরা মানসম্মত সেবা থেকে বঞ্চিত। এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশলের সুষ্ঠু প্রয়োগসহ ১৫টি সুপারিশ করেছে টিআইবি।
বিআরটিএর এই ঘুষ লেনদেন মন্ত্রণালয় পর্যন্ত পৌঁছায় কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখানে একটু গণতন্ত্র বিরাজ করছে, ভাগাভাগি হচ্ছে। পার্টিকুলার কোথায় যাচ্ছে সেটা বলা যাবে না। দলীয় পরিচয়ে সড়কে চাঁদাবাজি হচ্ছে। ট্রাফিক হাইওয়ে পুলিশ, সিটি করপোরেশনে অনিয়ম হচ্ছে। বিআরটিএ তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, অনুমান করা যায় বিআরটিতে যে ঘুষ নেওয়া হয় তা সংস্থাটির কর্মকর্তাদের একাংশ পেয়ে থাকে। যেহেতু বিআরটিএকে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না, সেহেতু এর অংশীদারত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, মালিক-শ্রমিক আঁতাতের কাছে সরকার তুলনামূলকভাবে ক্ষমতাহীন। সরকারি আইনে সবচেয়ে বড় বাধা এই মালিক-শ্রমিক আঁতাত। তারাই সরকারের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান, এ কারণে যাত্রীরা প্রত্যাশিত সেবা পায় না।
তিনি বলেন, চাঁদাবাজির এ হিসাব খুবই রক্ষণশীল। বাস্তবে এর চেয়ে বহুগুণ বেশি চাঁদাবাজি হয়। এই চাঁদার ভাগ নানা পর্যায়ে যায়। যেহেতু খাতটি রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে, ফলে চাঁদার নিয়ন্ত্রণও তাদের হাতে।
২৪ শতাংশ বাসেরই
ফিটনেস নেই
দেশে চলাচলকারী ১৮.৯ শতাংশ বাসের নিবন্ধন, ২৪ শতাংশ বাসের ফিটনেস, ১৮.৫ শতাংশ বাসের ট্যাক্স টোকেন ও ২২ শতাংশ বাসের রুট পারমিট নেই বলে জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
সড়কে বাণিজ্যিকভাবে চলাচলকারী প্রত্যেকটি বাসের জন্য নিবন্ধন ও তিন ধরনের সনদ বাধ্যতামূলক।
কিন্তু ৪০.৯ শতাংশ বাসকর্মী ও শ্রমিকদের মতে, সংশ্লিষ্ট কোম্পানির এক বা একাধিক বাসের নিবন্ধনসহ কোনো না কোনো সনদের ঘাটতি আছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বাস শ্রমিকদের প্রতিদিন প্রায় ১১ ঘণ্টা কাজ করতে হয়। আর তাদের মধ্যে ৮২ শতাংশের কোনো নিয়োগপত্র নেই, ৬৯.৩ শতাংশের নেই নির্ধারিত মজুরি।
যাত্রী সেবা প্রসঙ্গে সংস্থাটির দাবি, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭৫.৮ শতাংশ যাত্রী, ৪৮ শতাংশ শ্রমিক এবং ৫১.৮ শতাংশ মালিক বাসের মাত্রাতিরিক্ত গতিকে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে উলেস্নখ করেছেন।
২২.২ শতাংশ কর্মী/শ্রমিকের মতে, মদ্যপান বা নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালক গাড়ি চালান এবং কন্ডাক্টর/হেলপার/সুপারভাইজার বাসে দায়িত্ব পালন করেন। সিটি সার্ভিসের ক্ষেত্রে এ হার ৪৫.৯ এবং আন্তঃজেলার ক্ষেত্রে ১৯.২ শতাংশ বলে জানায় সংস্থাটি।
নির্দেশনার যথাযথ প্রয়োগের অভাবে চলন্ত বাসে চালকরা ফোন ব্যবহার করেন। এর ফলে অনেক সময় প্রাণহানিসহ দুর্ঘটনা ঘটে বলেও জানানো হয়।
তবে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃতু্যর সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের সঙ্গে বিআরটিএ এর প্রকাশিত তথ্যের গড়মিল হয় বলে দাবি করছে টিআইবি।
বিআরটিএ এর তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালে মোট মৃতু্যর সংখ্যা ৫ হাজার ২৪ জন এবং যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যানুযায়ী এ সংখ্যা ৭ হাজার ৯০২ জন।