অভিযান চলবে দীর্ঘমেয়াদে পাঁচ মামলায় ৩৮১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে
ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ উচ্ছেদে হার্ডলাইনে সরকার
প্রকাশ | ০৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ১২টি রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সেই সঙ্গে ভবনের রুফটপে অবস্থিত দুটি রেস্তোরাঁর স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ওই এলাকার কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবনটি সিলগালা করে দেয় দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একটি দল। এ ছাড়া রাজধানীর ওয়ারী এলাকায় আবাসিক ভবনে থাকা রেস্টুরেন্টগুলোর বিরুদ্ধে অভিযানে নেমেছে পুলিশ।
প্রশাসনিক সূত্রে জানা গেছে, অবকাঠামোগত ত্রম্নটি, ভবন ব্যবহারে অনিয়ম ও যথাযথ অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা না থাকা ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁর বিরুদ্ধে অবশেষে হার্ডলাইনে সরকার। ঝুঁকিপূর্ণ রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে এ অভিযান দীর্ঘমেয়াদে ধারাবাহিকভাবে চলবে। যেসব রেস্তোরাঁয় অগ্নিঝুঁকি রয়েছে ও নিরাপত্তা নেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আবাসিক ভবনে অবৈধভাবে রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলা হলে শুধু ওইসব প্রতিষ্ঠানের মালিকই নয়, বাড়িওয়ালাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। এ ছাড়া অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ তৈরি এবং তাতে নির্বিঘ্নে ব্যবসা পরিচালনার প্রশ্রয়দাতা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কর্মকর্তাদেরও সাজার আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ব্যাপারে এরই মধ্যে সবাইকে হুঁশিয়ার করা হয়েছে।
এদিকে বেইলি রোডের ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ৪৬ জনের মর্মান্তিক মৃতু্যর পর ঝুঁকিপূর্ণ ও অবৈধ রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে রাজউক, সিটি করপোরেশন ও পুলিশের আকস্মিক অভিযান শুরুর পর হোটেল মালিকরা তটস্থ হয়ে পড়েছেন। বিশেষ করে কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার তোয়াক্কা না করে আবাসিক ভবনে যেসব রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে ওইসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ম্যানেজাররা এখন ভীত-সন্ত্রস্ত। তাদের কেউ কেউ রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন। কেউ আবার আশপাশে থেকে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।
অন্যদিকে এসব অবৈধ হোটেল মালিকরা গোপনে সংঘবদ্ধ হয়ে অভিযান ঠেকানোর ষড়যন্ত্র করছে বলেও গোয়েন্দারা তথ্য পেয়েছেন। তবে তাদের এ অপতৎপরতা
শক্তভাবে প্রতিহত করতে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখা হয়েছে বলে পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, থানা ও ডিবি পুলিশ রাজধানীর বিভিন্ন রেস্টুরেন্টে নজর রাখছে। ঢাকা শহরের যেসব রেস্তোরাঁয় অগ্নি নিরাপত্তা মানা হচ্ছে না এবং যেসব রেস্টুরেন্ট থেকে দ্রম্নত বের হওয়ার রাস্তা নেই সেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হবে এবং পুলিশ এ ব্যপারে আইনগত পদক্ষেপ নেবে।
গোয়েন্দা এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, 'এমন দুর্ঘটনার পেছনে গাফিলতি থাকেই। ঘটনা ঘটার পর আমরা গাফিলতি খুঁজি। নিয়ম-কানুন না মেনে যত্রতত্রভাবে ভবন বানানো হচ্ছে। এসব ভবনের খোঁজখবর যদি আগে থেকে নিয়ে রাখা হতো তাহলে বঙ্গবাজার, নিমতলি, বনানীর এফআর টাওয়ারে মতো এমন ঘটনা বারবার ঘটত না।'
এদিকে, রোববার দুপুরে ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের গাউসিয়া টুইন পিক ভবনের ১২টি রেস্তোরাঁ সিলগালা করার নির্দেশ দেন রাজউকের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তাজিনা সারোয়ার। এর আগে তার নির্দেশে ভবনটির ছাদে দুটি স্থাপনা ভেঙে ফেলা হয়।
অভিযান শেষে তাজিনা সারোয়ার সাংবাদিকদের বলেন, 'এ ভবনটি এফ-ওয়ান ক্যাটাগরিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। ওই ক্যাটাগরি অনুসারে ভবনটি অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু পরিদর্শনে মাত্র দুই ফ্লোরের কিছু অংশ অফিস হিসেবে বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকি অংশে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ১২ থেকে ১৫টি রেস্টুরেন্টকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ওষুধ ও কাপড়ের দোকান রয়েছে। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ভাড়া দেওয়ার কারণে রাজউকের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালিয়েছে। রেস্টুরেন্টগুলো সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে।
গাউসিয়া টুইন পিক বিল্ডিংয়ের সার্ভিস ম্যানেজার আলমগীর হোসেন বলেন, 'রাজউক কর্মকর্তারা রোববার এসে পুরো বিল্ডিং ঘুরে দেখেন। এরপর সোমবার সব রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দিয়েছেন। থানার পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে, সব রেস্তোরাঁকে লাইসেন্স নিয়ে তিন দিনের মধ্যে থানায় যেতে।'
তিনি আরও বলেন, সকালে রাজউক টিম নিয়ে এসে ভাঙা শুরু করেছে। কোনো মালামাল সরানোর সুযোগ দেওয়া হয়নি। কোনো স্টাফ নেই এখানে, সবাইকে রোববার ছুটি দেওয়া হয়েছে।'
এদিকে রাজধানীর ধানমন্ডির সাত মসজিদ রোডের কেয়ারি ক্রিসেন্ট ভবনটি সিলগালা করে দিয়েছে দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একটি দল। নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি দল সোমবার দুপুরে এ অভিযান পরিচালনা করে। এ সময় ভবনটি থেকে তিনজনকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়।
এর আগে ওই ভবনে অভিযান চালানো হবে এমন খবরে নোটিশ টাঙিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয় সেখানে থাকা সব রেস্টুরেন্ট। ভবনের মূল গেটের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় নোটিশ। তাতে লেখা হয় 'সব চাইনিজ রেস্টুরেন্ট এবং খাবার হোটেল বন্ধ থাকবে। শুধু দ্বিতীয়তলার মার্কেট এবং নিচতলার দোকানগুলো খোলা থাকবে। আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ।'
অভিযানের সময় ভবনটির দ্বিতীয়তলা থেকে ওপরের দিকের সব রেস্টুরেন্ট তালা লাগানো অবস্থায় পাওয়া যায়। কথা বলার জন্য ভবন সংশ্লিষ্টদের ডাকা হলেও তারা কেউ আসেননি। পরে সেখানে অভিযান শুরু হয়।
অন্যদিকে রোববার সন্ধ্যা থেকে রাজধানীজুড়ে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনা করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। অভিযানে রেস্তোরাঁগুলোর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ যথাযথ অনুমতি আছে কিনা সেগুলো দেখা হয়। অভিযানে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় অনিয়ম থাকার কারণে মোট ৩৫ জনকে আটক করে পুলিশ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অন্য একটি সূত্র জানায়, গত ২৪ ঘণ্টার অভিযানে পাঁচ মামলায় ৩৮১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। রোববার সন্ধ্যা থেকে এ অভিযান শুরু হয়। আটক ব্যক্তিদের বেশিরভাগই রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার। তাদের কাছে রেস্টুরেন্ট পরিচালনার বৈধ সব ডকুমেন্টস চাওয়া হয়েছে। এসব ডকুমেন্টস দেখে যাচাই-বাছাই করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পুলিশের ওয়ারী ডিভিশনের ডিসি ইকবাল হোসাইন বলেন, 'আমরা র?্যাঙ্কিন স্ট্রিটের ভবনগুলোতে অভিযান পরিচালনা করেছি। আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছে। সেগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।'
তিনি আরও জানান, অবহেলা, তাচ্ছিল্য ও বিপদজ্জনকভাবে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করে যারা আবাসিক ভবনে রেস্টুরেন্ট করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অভিযান চলবে।
স্থানীয়রা জানায়, অভিযানের শুরুতে পুলিশর্ যাংকিং স্ট্রিটের 'আই লাভ মেজ্জান' রেস্টুরেন্ট পরিদর্শন করেন। সেখানে রেস্টুরেন্টের ভেতরে কিচেন দেখা যায়। কিচেনের পাশে এক্সিট পথ থাকলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে এবং সেই পথে বিভিন্ন মালামাল রেখে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রাখা হয়েছে।
অভিযান শেষে ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) মো. ইকবাল হোসাইন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা রোববার রাত থেকে অভিযানে নেমেছি। বিশেষ করে ওয়ারী থানারর্ যাংকিং স্ট্রিট ব্যস্ততম একটি জায়গা। এই রাস্তায় ৫০টিরও বেশি রেস্টুরেন্ট রয়েছে। এই রেস্টুরেন্টগুলো আমরা ভিজিট করেছি। ভিজিট করতে গিয়ে যা পেয়েছি, তা হলো- বেশিরভাগ রেস্টুরেন্টই আবাসিক ভবনে স্থাপন করা হয়েছে। গ্যাস সিলিন্ডার দিয়ে তারা রান্নার কাজ চালাচ্ছে। আমরা ভিজিট করে দেখেছি, রেস্টুরেন্টের কাস্টমার সেফটি কোড, কিচেন কোড কোনো কিছুই তারা নিশ্চিত করতে পারেনি।
তিনি আরও বলেন, এমনকি এও দেখেছি যে, কিচেন ৪ ফুট বাই ৬ ফুট জায়গার মধ্যে করা হয়েছে। এমন সংকীর্ণ জায়গায় সাত থেকে আটজন শেফ রান্না করছেন। যে দরজা খুলে কিচেন থেকে বের হবে, সেই দরজার সামনে চালের বস্তা, আটার বস্তা রাখা হয়েছে। একই জায়গায় গ্যাস সিলিন্ডার, জেনারেটর রাখা হয়েছে। মূলত অনিরাপদ অবস্থায় তারা রেস্টুরেন্টগুলো পরিচালনা করছে।