উপরে আবাসিক, নিচে রেস্তোরাঁ-মার্কেট
চট্টগ্রামে অগ্নিঝুঁকিতে হাজার হাজার বহুতল ভবন
প্রকাশ | ০৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
সনজীবনাথ, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম মহানগরীর বায়েজিদ বোস্তামী সড়কের ২ নম্বর গেট এলাকায় আটতলা বিশিষ্ট ইভস টাওয়ারের দোতলা ও পাঁচ তলায় রয়েছে একটি করে রেস্তোরাঁ। এসব রেস্তোরাঁর রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার। তাও এই সিলিন্ডার রাখা হয়েছে গাড়ি রাখার জায়গায় (গ্যারেজে)। এই টাওয়ারে রয়েছে একটি মাত্র সিঁড়ি। বিকল্প কোনো সিঁড়ি নেই।
একই এলাকায় ১৬ তলার আরেকটি ভবনে দু'টি রেস্তোরাঁ রয়েছে। ভবনটিতে বিকল্প সিঁড়ি থাকলেও রেস্তোরাঁর গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে সিঁড়ির নিচে। এক সময় হাসপাতাল ও বিদ্যালয় ছিল। এখন তা নেই। ফলে ভবনের চতুর্থ ও পঞ্চম তলার বেশির ভাগ রুম খালি। তবে ভবনে উপরের ছয়তলা থেকে পুরোটাই আবাসিক।
এই ভবনের পাশেই রয়েছে ইয়াকুব ট্রেড সেন্টার। আটতলার এই ভবনে ব্যাংক, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ধরনের অফিস রয়েছে। ভবনটিতেও কোনো বিকল্প সিঁড়ি বা জরুরি বহির্গমন পথ নেই। যা অগ্নিনিরাপত্তার জন্য মারাত্মক হুমকি। এসব ভবনে আগুন লাগলে নিশ্চিত প্রাণহানি ঘটবে। এমন মন্তব্য স্থানীয়দের।
রোববার চট্টগ্রাম মহানগরের ২ নম্বর গেট, জিইসি মোড়, প্রবর্তক মোড়, চকবাজার এলাকায় বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন সরেজমিন ঘুরে এমন দৃশ্য চোখে পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, এ সময় ভবনগুলোতে অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি নিয়েও সহপাঠীদের মধ্যে নানা রকম আশঙ্কার কথা শুনা গেছে।
এর মধ্যে ইয়াকুব ট্রেড সেন্টারে আলিফ রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেতে আসা ব্যাংক কর্মকর্তা নাঈমুর রহমান রাজধানী ঢাকার বেইলি রোডের বহুতল ভবনে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ৪৬ জনের মৃতু্যর প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ঢাকার চেয়েও চট্টগ্রামে হাজার হাজার বহুতল ভবন মারাত্মক অগ্নিঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, চট্টগ্রাম মহানগরের অধিকাংশ ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। এতে কোনো কারণে আগুন লাগলে ভবন থেকে মানুষের দ্রম্নত বেরিয়ে আসা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। ফলে ঢাকার
মতো প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। তাছাড়া নকশা অনুযায়ী ভবন নির্মিত হয়েছে কিনা, তা দেখার দায়িত্ব চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক)।
তিনি বলেন, অগ্নিনিরাপত্তায় কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে, তা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা, ২০০৮-এ। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, নকশা অনুমোদন দিয়েই দায় সারে সংস্থাটি। নকশা অনুযায়ী ভবন হয়েছে কিনা, তা যাচাইয়ের কাজটি ঠিকমতো করে না চউক।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন চউকের প্রধাননগর-পরিকল্পনাবিদ কাজী হাসান বিন শামস। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে বহুতল ভবনের একটিতে ও অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা (ফায়ার সেফটি পস্ন্যান) মেনেচলা হয় না। ঢাকার বেইলি রোডের বহুতল ভবনের মতো এখানেও যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। চট্টগ্রামের যেসব স্থাপনায় জমায়েত বেশি হয়, সেগুলো নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে কিনা তদন্ত করা হবে। নকশা বহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণ করলে এবং অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা না থাকলে নকশা বাতিলসহ কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
চউক কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ বহুতল ভবনে অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা দুর্বল। কিছু কিছু ভবনে নামমাত্র ব্যবস্থা থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। এতে কোনো কারণে আগুন লাগলে ভবন থেকে মানুষের দ্রম্নত বেরিয়ে আসা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়বে। ফলে ঢাকার মতো প্রাণহানির ঘটনা ঘটতে পারে।
চউকের তালিকা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম মহানগরে ৬ থেকে ১০ তলা পর্যন্ত ভবন রয়েছে ১৩ হাজার ১৩৫টি। ১০ তলার ওপরে ভবন রয়েছে ৫২৭টি। এসবের মধ্যে কী পরিমাণ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে, তার কোনো পূর্ণাঙ্গ তালিকা কোনো সংস্থার কাছে নেই।
তবে ২০১৮ সালে ফায়ার সার্ভিস পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, চট্টগ্রামে ৯৩ শতাংশ ভবনের ফায়ার সার্ভিসের অনাপত্তিপত্র নেই। অথচ ভবন নির্মাণ শেষ হওয়ার পর ফায়ার সার্ভিস থেকে অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান আছে। ৯৭ শতাংশ ভবনের সেই ছাড়পত্র নেই। ৯৭ শতাংশ ভবনে অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতের কোনো ব্যবস্থাই নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রাম অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল মালেক বলেন, চট্টগ্রাম মহানগরের অধিকাংশ বহুতল আবাসিক ভবন ও বিপণিবিতানে পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা নেই। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যবস্থা থাকলেও তা ব্যবহারে রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। এর মধ্যে অনেক ভবনে খোলা হয়েছে খাবারের দোকান বা রেস্তোরাঁ। এসব কারণে ভবনগুলোতে বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বেড়েছে।
অন্যদিকে ছয়তলার ওপর ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে ফায়ার সার্ভিসের ছাড়পত্র নেওয়া বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী, ভবনগুলোতে বিকল্প সিঁড়ি থাকতে হবে। থাকতে হবে জরুরি বহির্গমন পথ। পর্যাপ্ত ও কার্যকর অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, আলো-বাতাস প্রবাহের পরিসর। সব ইমারতে জরুরি প্রস্থান প্রদর্শনকারী দিকচিহ্ন থাকতে হবে। ২০ মিটার বা এর বেশি উচ্চতায় এক বা একাধিক তলা আছে এমন ভবনে অগ্নিনিরাপদ সিঁড়ি থাকতে হবে। জরুরি বহির্গমন পথকে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না, যাতে চলাচলের পথ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রশিক্ষণও নেই ভবনের বাসিন্দাদের। এ হিসেবে বলতে গেলে, চট্টগ্রামের প্রায় সব বহুতল ভবনই আগুনের ঝুঁকিতে আছে।
সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন-২০০৩ অনুযায়ী ছয়তলার বেশি উচ্চতার ভবন নির্মাণ করতে হলে তিন স্তরের অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। এর নিচে হলে দুই স্তরের অগ্নিনিরাপত্তা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে। এই আইন অনুযায়ী, যেকোনো বহুতল ভবন নির্মাণের আগে অনাপত্তিপত্র নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। ভবন নির্মাণের কাজ শুরুর ১৫ দিনের মধ্যে চিঠি দিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে অবহিত করতে হবে। ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে বসবাস ও ছাড়পত্রের আবেদন করতে হবে।
তবে এর আগে ফায়ার ফাইটিং ফোর পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবনের স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, জরুরি নির্গমণ সিঁড়ি, ফায়ার লিফট, ফায়ার কমান্ড স্টেশন স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। এরপর ফায়ার সার্ভিস সেখানে বসবাসের জন্য ছাড়পত্র দেবে।
বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, এই ছাড়পত্র পাওয়ার অনধিক তিন মাসের মধ্যে প্রত্যেক বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করতে হবে। কমিটির তত্ত্বাবধানে ২০ শতাংশ বসবাসকারীকে ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার এবং প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে মৌলিক সাধারণ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হবে। দুই বছর পর্যন্ত প্রতি তিন মাস পরপর এবং এরপর থেকে ছয় মাস পরপর ভবনে ফায়ার মহড়ার আয়োজন করতে হবে।
দুই বছর পরপর একজন ডিপেস্নামা প্রকৌশলীর মাধ্যমে বৈদু্যতিক স্থাপনা, ফিটিংস ও ওয়্যারিং পরীক্ষা করতে হবে। ভবনে ব্যবহৃত আসবাব অগ্নিনিরোধক হতে হবে। ফায়ার এক্সিট আগুন, সিগারেটের ধোঁয়া ও তাপমুক্ত হতে হবে। এই আইন অমান্য করলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ যেকোনো সময় ভবনটিকে আবাসিক অথবা বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করতে পারবে।
উায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষের তালিকায় অগ্নিকান্ডের মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ২০০ মার্কেটের রিয়াজ উদ্দিন বাজার। এই বাজারে ১০ হাজারের বেশি দোকান রয়েছে। অগ্নিঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য মার্কেটগুলো হচ্ছে- খাতুনগঞ্জ, জহুর মার্কেট, টেরিবাজার, তামাকুমন্ডি লেন, গোলাম রসুল মার্কেট, বাগদাদ ইলেকট্রিক সুপার মার্কেট, হাজি সরুমিয়া মার্কেট, নূপুর মার্কেট, ঝাউতলা বস্তি, আমবাগান বস্তি, সেগুনবাগান বস্তি, কদমতলী রেলওয়ে বস্তি, সিঙ্গাপুর সমবায় মার্কেট, কর্ণফুলী মার্কেট, পোর্ট মার্কেট, বড়পুলবাজার, ইসামিস্ত্রি মার্কেট, ফকিরহাট মার্কেট, নয়াবাজার মার্কেট, ফইল্যাতলি বাজার।
এছাড়া ইপিজেড ফায়ার স্টেশনের অধীন চৌধুরী মার্কেট, কলসি দিঘিরপাড় কলোনি, আকমল আলী কলোনি, মহাজন টাওয়ার, রেলওয়ে বস্তি, চকভিউ সুপার মার্কেট, কেয়ারি শপিংমল, গুলজার মার্কেট, আলী মার্কেট, মতি টাওয়ার, শাহেন শাহ মার্কেট, হক মার্কেট, স্বজন সুপার মার্কেট, বখতেয়ার সুপার মার্কেট, নজুমিয়াহাট মার্কেট এবং বলিরহাট মার্কেটও রয়েছে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিঝুঁকির তালিকায়।
এর পাশাপাশি এই তালিকায় আরও রয়েছে- লামার বাজার স্টেশনের অধীন ভেড়া মার্কেট, চালপট্টি, শুঁটকিপট্টি, খাতুনগঞ্জ, আছদগঞ্জ, মিয়া খান পুরনো জুট মার্কেট ও ওমর আলী মার্কেট, রেলওয়ে বস্তি, অক্সিজেন এলাকার রেলওয়ে বস্তি, বার্মাকলোনি, ২ নম্বর গেট ড্রাইভার কলোনি, রৌফাবাদ কলোনি, শের শাহ কলোনি, শেখ ফরিদ মার্কেট, যমুনা সুপার মার্কেট, ষোলশহর সুপার মার্কেট, ইমাম শপিং কমপেস্নক্স এবং চট্টগ্রাম শপিং কমপেস্নক্স।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রাম বিভাগীয় দপ্তরের উপ-পরিচালক দিন মনিশর্মা বলেন, শিগগিরই আমরা অভিযানে নামছি। শুরুতে প্রতিটি বহুতল ভবন পরিদর্শন করে ত্রম্নটি খুঁজে পেলে তা শোধরাতে সময় দেব। এর মধ্যে না শোধরালে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে নোটিশ দেওয়া হবে। এরপরও সংশোধন না হলে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।