অগ্নিঝরা মার্চ

রেডিও-টেলিভিশনের নাম পরিবর্তন

প্রকাশ | ০৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
একাত্তরের মার্চে ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছিল বাঙালির বিক্ষোভ-দ্রোহ। বঙ্গবন্ধুর ডাকে লাগাতার হরতালের তৃতীয় দিন ৪ মার্চ পাকিস্তান টেলিভিশন ও পাকিস্তান রেডিও নাম পরিবর্তন করে 'ঢাকা টেলিভিশন' ও 'ঢাকা বেতার কেন্দ্র' হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে। এদিন এক বিবৃতির মাধ্যমে 'ঘরে ঘরে প্রস্তুতির ডাক' দেন বঙ্গবন্ধু। এছাড়া তিনি বিভিন্ন কমিটি গঠন ও মুক্তিবাহিনী প্রস্তুত করতে ডাক দেন। অন্যদিকে এদিনে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ তাদের যার যার জায়গা থেকে করণীয় নির্ধারণ করে সেই অনুযায়ী সক্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেন। আগের দিন রাতে পাকিস্তান শাসকের জারি করা কারফিউ ভেঙে ক্ষুব্ধ জনতা মিছিল করে। ফলে এদিন কারফিউ তুলে নেয় সরকার। তবে ফুলনা ও রংপুরে কারফিউ বলবৎ থাকে। এদিন সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সারাদেশে পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল। শহর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ফরিদপুরের ইতিহাসে বৃহত্তর প্রতিবাদ মিছিল বের হয়। জনতার পদভারে কেঁপে ওঠে শহর। এদিন যশোরে সেনাবাহিনীর গুলিতে শহীদ হন চারুবালা ধর। জনতা লাশ নিয়ে মিছিল করে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানায়। একাত্তরের মার্চ মাসের বিভিন্ন পত্রিকার সূত্রে এদিনের ঘটনাবলি সম্পর্কে লেখক রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার 'একাত্তরের দশ মাস' বইয়ে উলেস্নখ করেছেন- 'বাংলার মুক্তি আন্দোলনের চতুর্থ দিনটি পূর্ণ হরতাল, বিক্ষুব্ধ শোভাযাত্রা, গায়েবানা জানাজা, সভা ও স্বাধীনতার শপথ নেবার মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। দেশের সর্বত্র বেসামরিক শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ে। ফলে অকার্যকর কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। ঢাকা বিমান বন্দরে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। ঢাকা শহরে সর্বত্র ব্যারিকেড রচনা চলতে থাকে। সকল সরকারি ও বেসরকারি অফিস, আদালত, সমস্ত ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, বিমান, রেল, স্টিমার, লঞ্চ, বাস, ট্যাক্সি, ব্যাংক ইনসু্যরেন্স, স্টক এক্সচেঞ্জ, নব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানি ওইদিন বন্ধ থাকে।' জানা যায়, এদিন চট্টগ্রামের পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটে। সেখানে বাঙালি-অবাঙালি সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে। ফলে হতাহতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একাত্তরের মার্চের ৩ ও ৪ তারিখের সংঘর্ষে ১২০ জন নিহত এবং ৩৩৫ জন আহত হয় বলে জানা যায়। এদিন খুলনায় পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সন্ধ্যায় শহরে সান্ধ্য আইন জারি করে পাকিস্তানি শাসকরা। রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার 'একাত্তরের দশ মাস' বইয়ে উলেস্নখ করেছেন- এদিন মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পৃথক বিবৃতিতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু এদিন ডাক দিলেন, যেকোনো মূল্যে মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। প্রস্তুত থাকতে হবে ঘরে ঘরে। শোষণ ও ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিটি নারী-পুরুষ যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে তা দেখে তিনি সবাইকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, 'আত্মত্যাগ ছাড়া মুক্তি আসবে না। কাজেই যেকোনো মূল্যে মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যেতেই হবে।' ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল পালনের আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'যেসব সরকারি ও বেসরকারি অফিসে কর্মচারীরা এখনো বেতন পাননি, শুধু বেতন দেওয়ার জন্য সেসব অফিস আড়াইটা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।' সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ওপর যেসব বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল অবিলম্বে তা প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন ৪ মার্চে একটি সভায় সিদ্ধান্ত নেয়, 'স্বাধীন মতামত প্রকাশের অধিকার না দিলে সাংবাদিকরা বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন না।' ওই সভায় বাংলার জনগণের সার্বিক মুক্তি আদায়ে গণআন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ও ৫৫ জন শিক্ষক এদিন 'পাকিস্তান অবজারভার' দৈনিকের গণবিরোধী ভূমিকায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। বেতার-টেলিভিশন-চলচ্চিত্র শিল্পীরা এক বিবৃতিতে 'যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্রসমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন, ততদিন পর্যন্ত তারা কোনো অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন না' বলে ঘোষণা দেন। বিবৃবিতে সই করেন, লায়লা আর্জুমান্দ বেগম, আফসারী খানম, আতীকুল ইসলাম, ফেরদৌসী রহমান, মুস্তাফা জামান আব্বাসী, গোলাম মোস্তফা, হাসান ইমাম, জাহেদুর রহিম, আলতাফ মাহমুদ, ওয়াহিদুল হক, এএম হামিদসহ আরও কয়েকজন। এদিন পিডিপি নেতা নূরুল আমিন ইয়াহিয়া খানের ১০ মার্চের ঢাকায় প্রস্তাবিত সম্মেলনে যোগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এদিন বিকালে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বিশাল গণসমাবেশে বিপস্নবী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন আওয়ামী লীগ সভাপতি এম আর সিদ্দিকী। এদিকে করাচি প্রেস ক্লাবে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান দেশকে বিচ্ছিন্নতার হাত থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে অবিলম্বে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান। এদিন রাত ১১টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে রাও ফরমান আলী বঙ্গবন্ধুর কাছে কতিপয় প্রস্তাব নিয়ে যান। দু'জনের কথা বলার সময় তাজউদ্দীন ঢুকে কোনো ভূমিকা ছাড়াই বলেন, 'এখন আর এক ছাদের নিচে আমাদের অবস্থান সম্ভব নয়। তাছাড়া যেখানে ভুট্টো রয়েছে।' তথ্যসূত্র: একাত্তরের দশ মাস, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, গতিধারা ১৯৯৭, ঢাকা; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র: দ্বিতীয় খন্ড, পৃ. ৬৬৬-৬৮।