তীব্র ডলার সংকট ও উচ্চ আমদানি মূল্যের কারণে অভ্যন্তরীণ গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে জোড় দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। মূলত শিল্প ও বিদু্যৎ খাতে গ্যাসের জোগান বাড়াতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, অবকাঠামো না থাকায় আমদানি করেও যেহেতু সংকট কাটছে না, তাই স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে অভ্যন্তরীণ উৎস হতে জ্বালানি উত্তোলনে সরকারের আগ্রহ বেড়েছে। সেক্ষেত্রে প্রত্যাশা অনেক থাকলেও প্রাপ্তি সামান্য- বলছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, বিদ্যমান গ্যাস সংকট মোকাবিলায় পেট্রোবাংলার স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনার মধ্যে ২০২৫ সাল নাগাদ ৪৬টি ও ২০২৮ সালের মধ্যে মোট ১শ'টি নতুন ও পুরনো কূপ খননের কাজ করবে। সে অনুযায়ী ২০২৫ সালের মধ্যে ৪৬টি কূপ খনন করা গেলে দিনে অন্তত ৭শ' মিলিয়ন ঘনফুট অতিরিক্ত গ্যাসের জোগান বাড়ানোর প্রত্যাশা করছে সংস্থাটি।
এরই অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ৯টি কূপ খননের কাজ শেষ হয়েছে। প্রাথমিক হিসাবে এই কূপগুলো থেকে চলতি বছরেই দিনে অন্তত ১২০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা যেতে পারে। এছাড়াও এ বছরের মধ্যে আরও ১০ থেকে ১২টি কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলনের প্রত্যাশার কথা যায়যায়দিনকে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার অপারেশনস অ্যান্ড মাইনিং বিভাগের কর্মকর্তারা। সে হিসাবে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ৩শ' মিলিয়ন ঘণফুট ও ২৫ সালের মধ্যে ৭শ' মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান বাড়তে পারে।
দেশে বর্তমান গ্যাসের চাহিদা দিনে প্রায় ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এর মধ্যে ২৭শ' মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের জোগান আসে দেশীয় উৎস থেকে। তবে চলতি ফেব্রম্নয়ারিতে ২৯টির মধ্যে ২০টি গ্যাসক্ষেত্রের ১১১টি কূপ থেকে দিনে গড়ে প্রায় দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। এর বাইরে আমদানি করা হয় আরও প্রায় সাড়ে ৬শ' মিলিয়ন ঘনফুট। এর পরেও ঘাটতি থাকে প্রায় ১৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। ফলে নতুন কূপ থেকে গ্যাস উত্তোলন শুরু করা হলেও তা ঘাটতি তুলনায় খুবই সামান্য।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গ্যাসের অভ্যন্তরীণ নতুন উৎস না পাওয়া গেলে ২০২৬ সালের মধ্যেই কূপগুলোর বিদ্যমান মজুদ অর্ধেকের নিচে নেমে যাবে। অন্যদিকে এ সময়ের মধ্যে চাহিদা বেড়ে ৬ হাজার মিলিয়ন ঘনফুটে ছাড়াতে পারে। আর এই পরিমাণ ঘাটতি আমদানির মাধ্যমে মেটানো প্রায় অসম্ভব। কারণ দিনে মাত্র ৬ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির ব্যয় মেটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে জ্বালানি বিভাগকে।
জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে তেল, গ্যাস এবং কয়লার সম্মিলিত আমদানি ব্যয় ১৩ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার, যা এ বছর আরও ৩ বিলিয়ন ডলার বেড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলার দরকার হতে পারে।
এদিকে দেশীয় গ্যাসে বিদু্যৎ উৎপাদনে ব্যয় অন্যান্য জ্বালানির থেকে অনেক কম। দিনে যদি দুই হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস বিদু্যৎ কেন্দ্রে সরবরাহ করা হয় তাহলে এ খাতে ভর্তুকি অন্তত ৭০ শতাংশ কমে যেত বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে বর্তমানে
মোট গ্যাস সরবরাহের ১৭ শতাংশ শিল্প মালিকানাধীন ক্যাপটিভ পাওয়ার পস্নান্টগুলোতে বরাদ্দ করা হয়, আর ৪৩ শতাংশ গ্রিড পাওয়ার পস্নান্টসমূহে দেওয়া হয়।
পেট্রোবাংলার পরিকল্পনা বিভাগের তথ্য মতে, ২০২৯ সালের মধ্যে দেশের গ্যাসের চাহিদা দিনে প্রায় ৭ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট হতে পারে। এর মধ্যে নিজস্ব উৎস হতে চার হাজার ৩৫২ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ করা যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যেই পেট্রোবাংলা এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
সম্প্রতি পেট্রোবাংলার এক সেমিনারে সংস্থাটির চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, ১০০টি কূপের মধ্যে বাপেক্স ৫২টি নতুন কূপ খনন করবে এবং বিদ্যমান ১৬টি কূপের সংস্কার করবে। এছাড়াও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড ৯টি নতুন কূপ খনন করবে এবং পুরনো সংস্কারপূর্ণ ১২টিতে খননকাজ চালাবে এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড ৮টি নতুন কূপ খনন করবে এবং পুরনো ৩টিতে সংস্কার কাজ চালাবে। এ জন্য তিন শতাধিক জায়গা চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখান থেকে যাচাই-বাছাই করে ১০০টি কূপ চূড়ান্ত করা হবে। মার্চের মধ্যেই এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা শুরু করা হবে। এছাড়া ও৪৮টি কূপ খননের চলমান প্রকল্প দ্রম্নতগতিতে এগিয়ে চলেছে, যা ২০২৫ সালের মধ্যে শেষ হবে বলেও জানান তিনি।
এদিকে বিদ্যমান প্রকল্পগুলোর সুবিধা পেতে ৩ বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে বলে জানিয়েছেন বিদু্যৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি এক সেমিনারে তিনি বলেন, গ্যাসের মজুত কমে যাওয়ার নিজস্ব গ্যাস উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতি দুই থেকে তিন বছর অব্যাহত থাকবে, তারপর আবার স্বাভাবিক হতে পারে। এছাড়াও এলএনজি আমদানিসহ জ্বালানি চাহিদা মেটাতে গত দুই বছরে ১১ বিলিয়ন ডলার অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে সরকারের। যদি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো টাকার চিন্তা না করে যথাযথ পদক্ষেপ নিলে গ্যাসের উত্তোলন আরও বাড়ানো যেত বলেও মনে করেন প্রতিমন্ত্রী।