'তখন প্রতি সেকেন্ডকে এক ঘণ্টার মতো মনে হচ্ছিল। আমার ১০ মাসের একটি মেয়ে রয়েছে। শুধু বাবা ডাকতে পারে। ওই ভয়াল সময়টায় শুধু মেয়ের ছবি চোখের সামনে ভাসছিল। ওর জন্য কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছিল'- শনিবার দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বেড়ে শুয়ে সাংবাদিকদের কাছে রাজধানীর বেইলি রোডের ভয়াবহ আগুন থেকে বেঁচে ফেরাদের একজন ব্যবসায়ী ফয়সাল আহমেদ এভাবেই বর্ণনা করছিলেন সেদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা।
তিনি জানান, তার বাবার জন্য দুটি পাঞ্জাবি পছন্দ করে কিনে টাকা পরিশোধ করছিলেন। ঠিক তখনই শুনতে পান ভবনটিতে আগুন লেগেছে। তাড়াহুড়া করে ভবনের তৃতীয় তলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে নিচে নেমে যান তিনি। কিন্তু বের হতে পারেননি। তার অভিযোগ, আগুন লাগার পর ভবনের গেট তালা দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তিনি আবার সিঁড়ি বেয়ে তিনতলার পাঞ্জাবির ওই দোকানে ঢুকে পড়েন। ততক্ষণে ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে পুরো কক্ষ। বিদু্যৎও চলে গেছে। পুরো ভবনেই আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ওই কক্ষে অনেকের সঙ্গে আটকে ছিলেন
\হফয়সাল। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর তাকে উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা। পরে তাকে ভর্তি করা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।
ফয়সাল বলেন, 'ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়লে শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। তখন মেঝেতে শুয়ে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। পাঞ্জাবি ও রুমাল ভিজিয়ে মুখে পানি দিচ্ছিলাম। বেঁচে ফেরার আশাও ছেড়ে দিয়েছিলাম।'
আগুন লাগার খবর পেয়ে তার বাবা বারবার ফোন করছিলেন ফয়সালকে। কয়েকবার বাবার ফোন কেটে দেন তিনি। বেঁচে ফিরবেন কিনা আর দেখা হবে কিনা, সেটা ভেবে পরে বাবার ফোন ধরে দোয়া করতে বলেন।
ফয়সালের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর উপজেলায়। পরিবার নিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জে থাকেন। সেখানে স্টার প্যাকেজিং নামে তার একটি কারখানা রয়েছে।
ফয়সাল আহমেদের মতো আগুনে দগ্ধ মেহেদী হাসানের চিকিৎসা চলছে বার্ন ইনস্টিটিউটে। তিনি বলেন, 'চীন থেকে তাদের এক বন্ধু এসেছেন। স্ত্রী উম্মে হাবিবাকে সঙ্গে নিয়ে ওই বন্ধুর সঙ্গে বেইলি রোডে খেতে গিয়েছিলেন তারা। খাবারের মেনু যখন হাতে নেন, ঠিক তখনই আগুন লেগে যায়। মেহেদী হাসান বলেন, 'ওইদিনের আগুনের বিমর্ষ ছবি আর মনে করতে চাই না।'
চার বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে খেতে এসেছিলেন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাদ মাহমুদ। তিনি বলেন, 'কয়েকবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামার চেষ্টা করেছি। আগুন লাগার কিছুক্ষণের মধ্যে পুরো ভবন ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। পরে সিঁড়ি দিয়ে নামতে পারিনি।' যখন পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে, তখন সবাই ছোটাছুটি করছিলেন। তখন বন্ধুদের হারিয়ে ফেলেন সাদ মাহমুদ।
সাদ আরও বলেন, 'ভবনের ছয়তলার একটি খাবারের দোকানের রান্নাঘরে ৬০-৭০ জন গিয়ে আশ্রয় নেন। অনেকেই বের হয়ে গেলে শেষ পর্যন্ত ১০-১৫ জন সেখানে ছিলেন। অনেকে ভয় পেয়ে ছয়তলার জানালা ভেঙে তার সামনেই লাফিয়ে নিচে পড়ছিলেন?। আগুনে তার দুই বন্ধু মারা গেছেন বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
আগুনের ভয়াবহতা ও মৃতু্যর পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন শুক্রবার বেইলি রোডে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অন্যদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে, ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদন ছিল না।