ডলারের দর বাজারভিত্তিক না হওয়ায় এখনো হুন্ডিকে বেছে নিচ্ছে প্রবাসীরা। আর এই সুযোগ নিচ্ছে দেশি-বিদেশি অর্থ পাচারকারী একটি চক্র। যে কারণে ২০২৩ সালে দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক জনশক্তি রপ্তানি করেও প্রবাসী আয় বাড়েনি। এজন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলারের দর বাজারভিত্তিক করার বিকল্প নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স নিয়ে দেশে-বিদেশে একটি চক্র অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত। ওই চক্রটি বিভিন্নভাবে খোলাবাজারের ডলার বেশি দর নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ) এ বিষয়ে কাজ করছে। তবে হুন্ডির এই চক্রটি এতই সংঘবদ্ধ তাদের শনাক্ত করা কঠিন বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
চক্রটির মধ্যে দেশীয় কিছু কোম্পানি রয়েছে। তারা বিভিন্ন পণ্যের আমদানি-রপ্তানির মাধ্যমে অর্থ পাচার করে থাকে। এর সঙ্গে ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারাও জড়িত।
এদিকে প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্স আহরণের উদ্যোগ একেবারেই কাজে আসেনি। এর প্রমাণ ২০২৩ সালের জনশক্তি ও রেমিট্যান্সের পরিসংখ্যান দেখলেই পরিষ্কার বুঝা যায়। ২০২৩ সালে দুই দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ জনশক্তি রপ্তানির রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। অথচ ওই বছরে সেভাবে বাড়েনি প্রবাসী আয়। গত দুই বছরে প্রবাসী আয় কমেছে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ বু্যরোর (বিএমইটি) তথ্য মতে, গত বছর বিশ্বের ১৩৭টি দেশে বাংলাদেশের ১৩ লাখ কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার। তবে জনশক্তি রপ্তানিতে মাইলফলক অর্জন সত্ত্বেও সে অনুযায়ী বাড়েনি রেমিট্যান্স প্রবাহ। ২০২৩ সালে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৩ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ২ হাজার ১৯২ কোটি বা ২১ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। আগের বছর যা ছিল ২ হাজার ১২৯ কোটি ২১.২৯ বিলিয়ন ডলার। গত দুই বছর ধরে রেমিট্যান্স প্রবাহ ২২ বিলিয়ন ডলারের নিচে স্থবির হয়ে আছে।
হুন্ডির প্রভাব সব সময়ই ছিল। কিন্তু ডলারের বাজারের অস্থিরতার কারণে কয়েক বছর ধরে তা আরও বেড়ে গেছে। এই রেমিট্যান্স কমার কারণেই মূলত দেশের রিজার্ভ কমে আসছে। যে কারণে গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ বাড়াতে টাকা-ডলার অদলবদল বা সোয়াপ পদ্ধতি চালু করেছে।
ব্যাংকিং চ্যানেলে অর্থাৎ বৈধ পথে টাকা পাঠালে সরকার প্রথমে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিত। এখন তা বাড়িয়ে ৫ শতাংশ
করা হয়েছে। প্রণোদনা দিয়ে রেমিট্যান্সের ধারা ইতিবাচক করা যায়নি। এরপর ব্যাংকগুলোকে আরও ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। তবুও কমছে না হুন্ডি। হুন্ডি বন্ধ করতে হলে ডলারের বাজারকে স্থিতিশীল করতে হবে। কার্ব মার্কেট ও ব্যাংকের ডলারের দামের পার্থক্য কমিয়ে আনতে হবে।
সরেজমিন দেখা গেছে, বর্তমানে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দর ১২৮ থেকে ১৩০ টাকা। ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে পাওয়া যায় ১১০ টাকা এবং তার সঙ্গে ৫ শতাংশ প্রণোদনা যোগ হয়ে পাওয়া যায় ১১৫ টাকা ৫০ পয়সা। আর হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠালে ১৩০ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। যে কারণে সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর পরিমাণ বেড়ে গেছে।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আগের বছরের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি জনশক্তি রপ্তানি করে রেকর্ড করেছে বাংলাদেশ। সৌদিতে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে কোটা বাড়ানো এবং মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার আবার খুলে দেওয়ার ফলে জনশক্তি রপ্তানির এই রেকর্ড সম্ভব হয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৩ সালে যে সংখ্যক কর্মী বিদেশে গেছে, সে অনুযায়ী আরও বেশি রেমিট্যান্স আসা উচিত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সবসময়ই বেশি রেমিট্যান্স আসে। তবে অর্থ পাচারের কারণে সেই রেমিট্যান্সের সবটুকু হয়তো ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে না। ফলে এসব দেশ থেকে কাঙ্ক্ষিত হারে রেমিট্যান্সও আসছে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০২৩ সালে যে সংখ্যক কর্মী বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছে, সে অনুযায়ী আরও বেশি রেমিট্যান্স আসা উচিত ছিল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে সবসময়ই বেশি রেমিট্যান্স আসে। তবে অর্থ পাচারের কারণে সেই রেমিট্যান্সের সবটুকু হয়তো ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে না। ফলে এসব দেশ থেকে কাঙ্ক্ষিত হারে রেমিট্যান্সও আসছে না।
এর আগে ২০২২ সালেও প্রায় ১১ লাখ লোক কাজের জন্য বিদেশ গিয়েছেন। যা আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের তুলনায় ৮৬ দশমিক ৩২ শতাংশ বেশি। ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯ জন। সেই হিসেবে ২০২২ সালেও রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি হবার কথা থাকলেও ফলাফল বিপরীত ছিল।
২০২২ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী সোয়া কোটি প্রবাসী বিভিন্ন ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে সব মিলিয়ে ২ হাজার ১২৮ কোটি ৫৪ লাখ বা ২১.২৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। যা ছিল ২০২১ সালের তুলনায় ৩ দশমিক ৫৬ শতাংশ কম। ২০২১ সালে প্রবাসীরা ডলার পাঠিয়েছিলেন ২ হাজার ২০৭ কোটি ২৫ লাখ বা ২২.০৭ বিলিয়ন ডলার। এর মূল কারণ হিসেবে ব্যাংকের চেয়ে খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি হওয়াকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। খোলাবাজার বা কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম বেশি হবার কারণে প্রবাসীরা একটু বেশি টাকা পাওয়ায় অবৈধ হুন্ডির মাধ্যমে তারা দেশে অর্থ পাঠাচ্ছে। যার ফলে কমেছে রেমিট্যান্স।
এ প্রসঙ্গে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, সরকার পাচার বন্ধে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করা উচিত। যেসব পরিকল্পনা কাজে লাগে না সেসব পরিকল্পনা নিয়ে বসে থেকে আরও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দেশ।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র বলছে, ডলারকে একেবারে বাজারভিত্তিক না করতে পারলেও শিগগিরই 'ক্রলিং পেগ' চালুর মাধ্যমে কিছুটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। হয়তো আগামীতে এর প্রভাব বাজারে দেখা যাবে।