বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
অগ্নিঝরা মার্চ

পল্টনের জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার

যাযাদি রিপোর্ট
  ০৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
পল্টনের জনসভায় স্বাধীনতার ইশতেহার

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার পর পূর্ব পাকিস্তান হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঢাকায় দ্বিতীয় দিনের মতো এবং দেশে প্রথম দিনের জন্য সর্বাত্মক হরতাল চলছিল। সেদিন শহরের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা স্তব্ধ প্রায়। বাঙালির প্রতিরোধ থামানোর জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান কৌশল অবলম্বন করে এক বেতার ঘোষণায় ১০ মার্চ জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারি গ্রম্নপের ১২ নেতাকে ঢাকায় এক বৈঠকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেন বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে বিকালে ছাত্রলীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভা থেকে 'স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ' স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘোষণাপত্র প্রচার করে।

দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকা সূত্রে একাত্তরের এদিনের ঘটনাবলি সম্পর্কে লেখক রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী তার 'একাত্তরের দশ মাস' বইয়ে উলেস্নখ করেছেন- 'জেনারেল ইয়াহিয়া এক বেতার ঘোষণায় ১০ মার্চ জাতীয় পরিষদের পার্লামেন্টারি গ্রম্নপের ১২ নেতাকে ঢাকায় এক বৈঠকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান।' অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এক বিবৃতিতে বলেন, 'ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে যখন নিরস্ত্র জনসাধারণকে ব্যাপকভাবে হত্যা করা হচ্ছে, শহীদদের তাজা খুন যখন রাজপথে শুকিয়ে যায়নি, কতিপয় নিহত ব্যক্তির লাশ

এখনো দাফন করা হয়নি, শত শত আহত ব্যক্তি যখন হাসপাতালে মৃতু্যর সঙ্গে সংগ্রাম করছে, ঠিক সেই সময় ঢাকায় ১০ মার্চ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের এক সম্মেলন বসার জন্য বেতার মারফত আমন্ত্রণের প্রস্তাব একটি নির্দয় তামাশা ছাড়া আর কিছুই নয়।'

বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, 'যখন সামরিক প্রস্তুতি অব্যাহত রয়েছে, কঠোর অস্ত্রের ভাষার ধ্বনি

আমাদের কানের কাছে এখনো ধ্বনিত হচ্ছে। এই অবস্থায় একটি সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো বস্তুত পক্ষে বন্দুকের মুখে আমন্ত্রণ জানানোর শামিল। এ অবস্থায় এ ধরনের আমন্ত্রণ গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না।'

এদিন বিকাল তিনটায় পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের ডাকা ছাত্র জনসভায় উপস্থিত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। সেদিনই সভা থেকে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের চার নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দুস মাখন স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার শপথ নেন।

ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে সেই সভায় সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন। মূলত এদিনই ঘোষিত হয় স্বাধীনতা-সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা। ইশতেহারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি' গানটিকে নির্বাচিত করা হয় জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে। ঠিক হয় বাংলাদেশের পতাকা হবে সবুজ জমিনের মাঝে লাল সূর্য, মাঝে সোনালি মানচিত্র।

'আমি যদি নাও থাকি, আন্দোলন যেন না থামে'- নেতাকর্মীদের এই নির্দেশনা দিয়ে বঙ্গবন্ধু জনসভায় আরও বলেন, 'আমার মৃতু্যতে যদি বাঙালি মুক্ত জীবন পায় এবং দুই বেলা পেট ভরে খেতে পায় তা হলেই আমি সুখী হবো। বাঙালি রক্ত দিয়ে আমাকে জেল থেকে ছাড়িয়ে এনেছে, এখনো রক্ত দিচ্ছে।'

বঙ্গবন্ধু বলেন, 'রক্ত আরও দেব- ৭ কোটি বাঙালিকে গুলি মেরে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আজ থেকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন চলবে।' এছাড়া বঙ্গবন্ধু কর-খাজনা না দেওয়ার ঘোষণা দেন। সামরিক সরকারকে গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি তাদের ব্যারাকে ফিরে যেতে বলেন। সাংবাদিকদের নির্ভীকভাবে সংবাদ পরিবেশনের এবং কোনো বিধিনিষেধ না মানার আহ্বান জানান।

এদিন ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম শহীদ মিনারের ছাত্রসভায় বলেন, 'বাংলাদেশে সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে।' এছাড়া এদিন বেলা ১১টায় গণহত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে বটতলায় ডা. মোজাফফর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে শিক্ষকদের এক প্রতিবাদ সভায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা জানিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে জনতার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা হয়।

তথ্যসূত্র : একাত্তরের দশ মাস, রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী, গতিধারা ১৯৯৭, ঢাকা; বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ দলিলপত্র :দ্বিতীয় খন্ড, পৃ. ৬৬৬-৬৮।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে