ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) মর্গের মেঝেতে শুইয়ে রাখা শিশুটির মরদেহ দেখা গিয়েছিল শুক্রবার। তার বুকের কাছে সাঁটানো কাগজে লেখা ছিল অজ্ঞাতনামা। মাথায় ঝুঁটি বাঁধা, ধূসর রঙের হাফহাতা গেঞ্জি আর নীল পায়জামা পরা শিশুটির মরদেহ দেখে মনে হচ্ছিল পড়ে আছে বিবর্ণ এক পুতুল। অবশেষে সেই শিশুটির পরিচয় জানা গেছে। তার নাম ফাইরুজ কাশেম জামিরা। বৃহস্পতিবার রাতে মা মেহেরুন নিসা জাহান হেলালি (২৪) এবং বাবা শাহজালাল উদ্দিনের (৩৪) সঙ্গে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি ভবনে গিয়েছিল শিশুটি। সেখানেই অগ্নিকান্ডে প্রাণ গেছে তার, প্রাণ গেছে তার মা-বাবারও। তিনজনের মরদেহ শুক্রবার রাতেই শনাক্ত করেছেন তার নানা মুক্তার আলম হেলালি।
শনিবার সকালে শিশুটির খালা মুক্তারুন নিসা হেলালি মুঠোফোনে বলেন, 'সকাল ৭টা থেকে তারা মর্গের সামনে অপেক্ষা করেছেন। তিনজনের মরদেহ নিয়ে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা কক্সবাজারের উখিয়ার উদ্দেশে রওনা দিয়েছেন। সেখানে পূর্ব গোয়ালিয়া গ্রামে বোনের শ্বশুরবাড়িতে তিনজনের দাফন সম্পন্ন হবে।'
কথা বলার সময় কাঁদছিলেন মুক্তারুন নিসা। তিনি বলেন, 'ফাইরুজের মা মেহেরুনের জন্মদিন ১৪ সেপ্টেম্বর। একই দিনে ফাইরুজও জন্ম নেয়।
গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর মা-মেয়ের জন্মদিন উদযাপন করা হয়। কেউ জানত না তাদের মৃতু্যর দিনটিও এক হবে।'
এদিকে রাতে মেয়ে, জামাতা ও নাতনির মরদেহ শনাক্তের পর থেকে আহাজারি থামছেই না মুক্তার আলম হেলালির। তিনি বলেন, 'জামাতা শাহজালাল উদ্দিন সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা ছিলেন। কেরানীগঞ্জের পানগাঁও কার্যালয়ে শুল্ক বিভাগে তিনি কর্মরত ছিলেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাস করতেন বসুন্ধরা রিভারভিউ এলাকায়। তিন দিনের ছুটিতে ওদের খাগড়াছড়ি বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল। মুঠোফোনে দীর্ঘ সময় ওদের খুঁজে না পেয়ে পরে হাসপাতালে যান।'
বেইলি রোডের ওই ভবনের আগুনে এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃতু্য হয়েছে। ১১ জন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তারা কেউ 'শঙ্কামুক্ত' নন। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে ৭৫ জনকে। আগুনের ভয়াবহতা ও মৃতু্যর পর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বেইলি রোডে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল; কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জানিয়েছে, ভবনটিতে রেস্তোরাঁ বা পণ্য বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কোনো অনুমোদন ছিল না।
আগুনের ঝুঁকি ও অনুমোদন না থাকার পরও ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ চলছিল বছরের পর বছর ধরে। সপ্তাহের শেষ কর্মদিবসে সেখানে খেতে ভিড় করেছিলেন নগরের বাসিন্দারা। কেউ গিয়েছিলেন শিশু-সন্তানদের নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন স্বজনদের নিয়ে, কেউ গিয়েছিলেন বন্ধুদের সঙ্গে। কারও কারও জীবন চলত ওই ভবনে থাকা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। আর এই ভবনের অগ্নিকান্ডে নিহতেরই একজন শিশু ফাইরুজ।
স্মরণকালের ভয়াবহ ওই অগ্নিদুর্ঘটনায় প্রাণ হারান ৪৬ জন। শুল্ক কর্মকর্তা শাহজালালের মতো বহু মানুষের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে 'গ্রিন কোজি কটেজ' ভবনের আগুনের লেলিহান শিখায়। স্ত্রী ও একমাত্র কন্যা ফাইরুজসহ নিহত শাহজালালের বাড়ি কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের পশ্চিম মরিচ্যা গ্রামে। তার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কাশেম।
তাদের খাগড়াছড়িতে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল জানিয়ে আবুল কাশেম সাংবাদিকদের বলেন, 'পাঁচ ছেলে, এক মেয়ের মধ্যে শাহজালাল উদ্দিন তৃতীয়। সে ২০১৭ সালে কাস্টমসের চাকরিতে যোগ দেয়। তার শেষ কর্মস্থল ছিল নারায়ণগঞ্জ জেলার পানগাঁও। ছেলে প্রতিদিন আমাকে ৩-৪ বার ফোন দিত। আমার ওষুধ সেবনের জন্য তাড়া দিত। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টার পর আমার সাথে শেষ কথা হয়েছিল তার।'
তিনি বলেন, 'ছেলে আমাকে জানিয়েছিল, টানা তিন দিনের ছুটি পাওয়ায় বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা থেকে স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে খাগড়াছড়ি ভ্রমণে যাচ্ছে। তার শ্যালিকার মেডিকেল কলেজে ভর্তি সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে শ্বশুর ঢাকা এসেছেন। তাদের সাথে দেখা করেই বাসে উঠে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে যাত্রা করবে।'
নিহত শাহজালাল উদ্দিনের ছোট ভাই কাশেম বিন লিংকন বলেন, 'বেইলি রোডের অগ্নিকান্ডের ২৪ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পর কক্সবাজার কাস্টমস অফিসের ভাইয়ের এক সহকর্মী ফোন করে জানান ফেসবুকে অজ্ঞাত পরিচয় যে কয়েকজনের মরদেহ দেখা যাচ্ছে তাদের মধ্যে তার ভাবী ও মেয়ের ছবি দেখা যাচ্ছে। ভাইয়ের বিষয়টি ওই সহকর্মী তখনও জানেন না।'
শাহজালালের একমাত্র বোন তসলিমা আকতার বলেন, 'ভাইদের মধ্যে অনেকটাই পিতার ভূমিকা পালন করতেন শাহজালাল। প্রতিনিয়ত ফোন করে খোঁজ-খবর নিতেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়ও ফোন করে কিছু লাগবে কিনা জানতে চেয়েছিলেন। সেই ভাই এখন নেই।'