বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

আগুন লাগে মানুষ মরে হোতারা থাকে আড়ালে

বেইলি রোড ট্র্যাজেডি
সাখাওয়াত হোসেন
  ০৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
আগুন লাগে মানুষ মরে হোতারা থাকে আড়ালে

অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নিয়মবহির্ভূতভাবে ভবনের ব্যবহার ও অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকাসহ নানা অনিয়মের কারণে একের পর এক ভয়াবহ অগ্নি দুর্ঘটনায় দিনে দিনে দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। বড় ধরনের অগ্নিকান্ডের পর অবৈধভাবে নির্মাণ ও ব্যবহারকারী ভবন মালিকদের বিরুদ্ধে দুই-চার দিন লোকদেখানো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও এসব অনিয়মের প্রশ্রয়দাতারা বরাবরই থাকছেন সাজার বাইরে। ফলে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা অগ্নিঝুঁকি সংক্রান্ত সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে নিষ্ক্রিয় থেকে ভবন মালিকদের কাছ থেকে এককালীন মোটা অঙ্কের উৎকোচ এবং নিয়মিত মাসোহারা আদায়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, নিয়মবহির্ভূতভাবে ভবন নির্মাণ, আবাসিক ভবনকে বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ব্যবহার এবং অগ্নিঝুঁকির তোয়াক্কা না করে অনিরাপদভাবে একই ভবনে বিপুলসংখ্যক হোটেল-রেস্টুরেন্টের ব্যবসা জাঁকিয়ে বসা বন্ধ করতে হলে এসব অনিয়মকারীদের পাশাপাশি তাদের প্রশ্রয়দাতাদের সাজার আওতায় আনা জরুরি। এ পদক্ষেপ গ্রহণে অসমর্থ হলে অগ্নি দুর্ঘটনার হিড়িক ঠেকানো যাবে না।

এ প্রসঙ্গে নগর পরিকল্পনাবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পস্ন্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বনানী এফআর টাওয়ার, মগবাজার ও বঙ্গবাজারের অগ্নিকান্ডের পর বেইলি রোডের ঘটনাটি ঢাকায় জীবনের নিরাপত্তার বিষয়টি আবার সবার সামনে নিয়ে এসেছে। অথচ নগর পরিকল্পনা, ভবনের ডিজাইন, নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনা, ভবনের ব্যবহার, ভবনের অগ্নি প্রতিরক্ষা, ফায়ার ড্রিল, ভবন মালিকের সচেতনতা ও দায়িত্বশীল আচরণ এবং নগর সংস্থাসমূহের নিয়মিত তদারকি থাকলে এই দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। আর তাই এ ধরনের

দুর্ঘটনা আসলে গাফিলতিজনিত হত্যাকান্ড হিসেবে বিবেচনা না করলে এবং এই বিষয়ে যেসব ব্যক্তি ও কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালনে গাফিলতি, উদাসীনতা, দায়িত্বহীন ও অন্যায় আচরণ করেছেন তাদের যথাযথ আইনের আওতায় না আনলে এর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা জানান, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামে ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য। কিন্তু এর বেশিরভাগই ব্যবহার হয়েছে রেস্তোরাঁ হিসেবে; যা সুস্পষ্টভাবে ইমারত আইন ও নগর পরিকল্পনার ব্যত্যয়। ভবনটিতে আটটি রেস্তোরাঁ, একটি জুস বার (ফলের রস বিক্রির দোকান) ও একটি চা-কফি বিক্রির দোকান ছিল। ছিল মোবাইল ও ইলেকট্রনিক সরঞ্জাম এবং পোশাক বিক্রির দোকানও। ভবনটিতে অগ্নি নিরাপত্তার পর্যাপ্ত কোনো ব্যবস্থাও ছিল না। ভবনের মালিকপক্ষের দায়িত্বহীনতা, ভবনে থাকা রেস্তোরাঁয় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে উদাসীনতার কারণেই অগ্নিকান্ডে এত প্রাণহানি হয়েছে। অথচ ভবনটিতে রেস্তোরাঁ করার কোনো অনুমতি ছিল না।

রাজউক কর্তৃক ভবনটির প্রথম থেকে পঞ্চম তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক (শুধু অফিসকক্ষ হিসেবে) এবং ষষ্ঠ ও সপ্তম তলা আবাসিক ব্যবহারের জন্য অনুমোদন দেয়। ভবনটিতে রেস্তোরাঁ, শোরুম (বিক্রয়কেন্দ্র) বা অন্য কিছু করার জন্য অনুমোদন নেওয়া হয়নি। কিন্তু ডেভেলপার কোম্পানি ভবন বুঝিয়ে দেওয়ার পর মালিকরা পুরো ভবনটি বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করছিলেন, যেখানে অনুমোদনহীনভাবে বেশিরভাগই ছিল রেস্টুরেন্ট। মালিকরা বেশি ভাড়ার জন্য এক কাজের জন্য অনুমতি নিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করছিলেন। অথচ সিটি করপোরেশন, গণপূর্ত ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বা ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কেউই এ অবৈধ অপতৎপরতায় ভবন মালিকদের কাউকে বাধা দেয়নি।

তবে অভিযোগ রয়েছে, অবকাঠামোগত দুর্বলতা, নিয়মবহির্ভূতভাবে ভবনের ব্যবহার ও অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়াদি দেখভালের দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা ওই ভবন মালিক ও সেখানকার রেস্তোরাঁগুলো থেকে নিয়মিত উৎকোচ আদায় করেছেন। যা অবৈধ অপতৎরতা চালানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সাহস জুগিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা নিজেদের দায় এড়িয়ে অবৈধ ভবন মালিক ও ব্যবহারকারীদের সর্বোচ্চ সুযোগ দিতে নানা ধরনের অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কোথাও অগ্নিকান্ডসহ ভয়াবহ কোনো দুর্ঘটনা ঘটার পর সেই অপকৌশলের ফাঁক গলে নিজেদের রক্ষা করেন। তবে দুর্ঘটনা ঘটার আগ পর্যন্ত তারা নানাভাবে অবৈধ ভবন নির্মাণকারী ও ব্যবহারকারীদের প্রশ্রয় দেন।

স্থানীয় একটি সূত্র জানায়, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে কার্যকর কোনো অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং অগ্নি নিরাপত্তা পরিকল্পনা ছিল না জানিয়ে এই দুর্ঘটনার আগে ফায়ার সার্ভিস তিনবার চিঠি দিয়েছে। ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ বলেও কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছে। কিন্তু ভবন মালিক ও ভবনের ব্যবহারকারীরা এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করলেও ফায়ার সার্ভিস তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। এ বিনিময়ে তারা অবৈধ সুবিধা নিয়েছে। শুধু তারাই নয়, এ বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব যাদের ওপর তারাও সবাই একই ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) স্থাপত্য বিভাগের সাবেক সহকারী অধ্যাপক মুস্তফা খালিদ পলাশ জানান, স্থপতি হিসেবে তার নকশা করা একটি ভবন ঝুঁকিপূর্ণভাবে ব্যবহার করায় তা বন্ধে তিনি নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে অদৃশ্য কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করায় এতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন।

এই স্থপতির ভাষ্য, ওই ভবনটির নকশা এবং অনুমোদন বাণিজ্যিক হিসেবে হলেও এর ব্যবহারে বড় রকমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রেস্তোরাঁ ভবনে রূপান্তর করা হয়েছে। স্থপতি হিসেবে শেষ যে ক্ষমতাটুকু রাজউক দিয়েছে অকুপেন্সি সার্টিফিকেটের জন্য রিপোর্ট স্বাক্ষর করার, তার তোয়াক্কাও এখানে করা হয়নি। অকুপেন্সি সার্টিফিকেট না নিয়েই ওই ভবনে ব্যবসা চলছে।

মুস্তফা খালিদ আরও জানান, ভবনটি নির্দিষ্ট ব্যবহারের ব্যত্যয় করে ব্যবহার শুরু করে দেওয়ায় স্থপতি হিসেবে রিপোর্ট ও এজবিল্ট ড্রয়িং প্রদান থেকে বিরত থেকে জমির মালিক, ডেভেলপারকে বারবার লিখিত বার্তায় এ বিষয়ে সতর্ক করেন। কিন্তু এতে কোনো ফলপ্রসূ অগ্রগতি হয়নি। ডেভেলপার ওই ভবনের ফায়ার লাইসেন্স থাকার দাবি করলেও তার কপি দেখাতে পারেননি। এ পরিস্থিতিতে গত মাসে ওই এলাকার ফায়ার সার্ভিসের স্টেশন মাস্টারকে বিষয়টি অবগত করলে তিনি তা গুরুত্বের সঙ্গে দেখার আশ্বাস দেন। তবে এখনো কাজের কাজ কিছু হয়নি।

অথচ ভবনটির ফায়ার ডোর খুলে ফেলা হয়েছে, ফায়ার স্টেয়ার স্টোররুম হয়েছে, যত্রতত্র গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছে।

অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে বেশিরভাগ ভবন ও বাসাবাড়িতে অগ্নি নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না এবং এ কারণেই এ ধরনের দুর্ঘটনার সময় ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা যায় না। যে কোনো ভবন বা বাসাবাড়িতে অগ্নি দুর্ঘটনা ঠেকাতে বা এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনতে হলে ভবন নির্মাণ পর্যায় থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। আর এ বিষয়টি দেখভালের জন্য প্রয়োজন দক্ষ মনিটরিং। অথচ দেশে এর যেমন তদারকিও নেই, তেমনি অনিয়মকারী ও তাদের প্রশ্রয়দাতাদেরও সাজার আওতায় আনা হচ্ছে না। যা অগ্নিকান্ডের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক পরিচালক এবং অগ্নি নিরাপত্তা সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান বিএম ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর এ কে এম শাকিল নওয়াজ বলেন, আগুন লাগলে সেটি ছড়িয়ে পড়া অনেকাংশেই ঠেকানো সম্ভব যদি আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া যায়। তার মতে, কোনো ভবনের অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে ভবনে দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। একটিকে তিনি উলেস্নখ করেছেন অ্যাকটিভ সিস্টেম বা সক্রিয় ব্যবস্থা এবং অন্যটি প্যাসিভ সিস্টেম বা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা।

শাকিল নেওয়াজ আরও বলেন, অগ্নি নিরাপত্তায় প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাটাই সবচেয়ে জরুরি। এটা বাড়ি নির্মাণের সময় মূল নকশার সঙ্গে সংযুক্ত থাকতে হবে এবং সিভিল ইঞ্জিনিয়ারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। আর সক্রিয় ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে আগুন ধরে গেলে সেটির ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে নানা ধরনের পদক্ষেপ। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত ভবনগুলোতে এ ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার কারণে সেখানে আগুন লাগার মতো দুর্ঘটনা কমে এসেছে এবং আগুন লাগলেও তা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকছে। একই কারণে এসব ভবনে আগুন লাগলে প্রাণহানি কম হয় বলেও জানান তিনি।

অগ্নি নির্বাপণ কর্মকান্ডের সঙ্গে জড়িতরা জানান, ঢাকায় সংঘটিত অগ্নিকান্ডের ঘটনা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এর পেছনে মূলত দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ। বেশিরভাগ ভবন নির্মাণ নীতিমালা (বিল্ডিং কোড) মেনে গড়ে উঠেনি। ঢাকা মহানগর ইমারত (নির্মাণ, উন্নয়ন, সংরক্ষণ ও অপসারণ) বিধিমালা ২০০৮-এ ইমারতে অগ্নি প্রতিরোধক দরজা, উপকরণ এবং অগ্নি নিরাপদ সিঁড়ি থাকার কথা রয়েছে। কিন্তু বিধিমালা লঙ্ঘন করেই যত্রতত্র গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, রেস্তোরাঁ, ঘিঞ্জি বসতি ও বাজার ব্যবস্থা। ২০০৩ সালে অগ্নিকান্ড রোধ ও নির্বাপণ আইন অনুযায়ী, কোনো ভবনে আগুন থেকে সুরক্ষার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না পেলে সেই ভবনকে অনুপযোগী ঘোষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিসকে। এছাড়া ২০০৬ সালে জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধিতে ভবনে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা রাখাকে আইনি বাধ্যবাধকতায় আনা হয়। কিন্তু এসব আইনকানুন ও নীতিমালার বাস্তবিক প্রয়োগ নেই। এসব শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ।

ফায়ার সার্ভিস কোনো ভবনকে অনুপযোগী ঘোষণা ও সতর্কবার্তা পাঠালেও সেসব ভবনে অবৈধভাবে কার্যক্রম চলতে থাকে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় অগ্নিকান্ডের মতো দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে