ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজের নকশা এবং ভবন ব্যবহারের অনুমোদন ছিল; তারপরও কেন আগুন ভয়াবহ রূপ পেল এবং কেন এত প্রাণহানি ঘটল, তা খতিয়ে দেখার কথা বলছে রাজউক।
২০১১ সালে একটি বেইজমেন্টসহ আট তলা আবাসিক কাম বাণিজ্যক ভবন হিসেবে গ্রিন কোজি কটেজের নকশা অনুমোদন দেয় রাজউক। ওই ভবনের জমির মালিক হামিদা খাতুন। আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন সেখানে ভবনটি তৈরি করেছে।
বৃহস্পতিবার রাত পৌনে ১০টার দিকে বেইলি রোডের ভবনটিতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে এ পর্যন্ত ৪৬ জনের মৃতু্যর খবর মিলেছে। আহতদের মধ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুজন এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও পস্নাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি আটজন ভর্তি
\হআছেন। বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি আটজনের অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ভবনটিতে নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। মাত্র একটি সিঁড়ি, প্রায় প্রতিটি ফ্লোরে খাবারের দোকান থাকায় গ্যাস সিলিন্ডারগুলো রাখা ছিল অপরিকল্পিতভাবে।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'ভবনের নকশা অনুমোদন করা আছে, আবাসিক কাম বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদনও আছে। আগুন লাগার পরপরই রাউজকের একদল কর্মকর্তা সেখানে যায়। সেখানে তারা দেখেছেন ভবনের সিঁড়ি নকশা অনুযায়ীই ছিল। অন্য কোনো ব্যত্যয় ছিল কি না সেটা খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।'
তিনি আরও বলেন, 'আইন অনুযায়ী কোনো ভবন ১০ তলার বেশি উচ্চতার হলে সেখানে ফায়ার এক্সিট লাগে। কিন্তু ওই ভবনটি আট তলা, তাই তারা ফায়ার এক্সিট রাখেনি। আবার একমাত্র সিঁড়িতে গ্যাসের সিলিন্ডার, দোকানের মালামাল রাখা ছিল। ফলে লোকজন বের হতে পারেনি।'
আশরাফুল ইসলাম বলেন, আট তলা ভবনের ক্ষেত্রে আইনি বাধ্যবাধকতা না থাকলেও ভবনটি যেহেতু বাণিজ্যিক, সেহেতু আলাদা অগ্নিনির্গমন পথ রাখা দরকার ছিল।'
তিনি আরও বলেন 'কারণ আবাসিক ভবন হলে কম লোক বাস করেন, আগুন লাগলে দ্রম্নত নামতে পারেন। কিন্তু বাণিজ্যিক ভবনে বহু মানুষ আসা-যাওয়া করে।'
ভবনটির দ্বিতীয় তলায় ছিল বিরিয়ানির দোকান 'কাচ্চি ভাই' এর শাখা, পোশাকের ব্র্যান্ড ইলিয়েন, নিচের তলায় স্যামসাং এর শোরুমসহ আরও বেশ কিছু দোকান।
স্যামসাংয়ের শোরুমের পাশে রয়েছে একটি কফি শপ। এরকম কফির দোকানসহ ফাস্টফুডের অনেকগুলো দোকান ও রেস্তোরাঁ রয়েছে ভবনটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
কাচ্চি ভাইয়ে ৫০ শতাংশ ছাড় থাকায় সেখানে অসম্ভব ভিড় ছিল বলে রাতে সোহেল আকবর নামের একজন জানিয়েছিলেন।
রাতে প্রায় দুই ঘণ্টার চেষ্টায় রাত ১১টা ৫০ মিনিটের দিকে আগুন নিভিয়ে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। এরপরই আসতে থাকে একের পর এক মৃতু্যর খবর
স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামন্ত লাল সেন শুক্রবার সকালে হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, যারা মারা গেছেন, তাদের বেশিরভাগ 'কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিংয়ের' শিকার হয়েছেন।
তিনি বলেন, 'অর্থাৎ, একটি বদ্ধ ঘর থেকে যখন ধোয়া বের হতে পারে না, তখন ধোঁয়াটা শ্বাসনালীতে চলে যায়। প্রত্যেকেরই তা হয়েছে। যাদের বেশি হয়েছে, তারা মারা গেছেন। তবে যারা আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি, তারা কেউ শঙ্কামুক্ত নয়।'
কীভাবে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল, তা নিয়েও রয়েছে অস্পষ্টতা। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক মো. মাইন উদ্দিন চুলা বা গ্যাস লিকেজ থেকে আগুন লাগতে পারে বলে প্রথমে বলেছিলেন। পরে তিনি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের তথ্য পাওয়ার কথাও বলেন।
আর অগ্নিকান্ডের সময় ঘটনাস্থলে থাকা র?্যাব-৩ এর এএসপি কামরুল হাসান বলেছিলেন, স্যামসাং শোরুমের (নিচতলায়) পাশের কফি হাউস থেকে প্রথম আগুনের সূত্রপাত হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা নিচ থেকে আগুন উপরের দিকে উঠতে দেখেছেন। প্রথমে দোতলায় তারপর তা পুরো ভবনে ছড়িয়ে যায়।
র্
যাবের ডিজি খুরশীদ আলম ঢাকা মেডিকেলে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও পস্নাস্টিক সার্জারি ইন্সটিটিউটে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের দেখার পর সাংবাদিকদের বলেন, 'নিচের একটি ছোট দোকানে প্রথমে আগুন লেগেছিল। সেখানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে তারা প্রাথমিকভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। তবে পরে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অধিকাংশ মানুষই ধোঁয়ার কারণে শ্বাসরোধে মারা গেছেন।'
তিনি বলেন, 'ভবনটিতে একটি মাত্র সিঁড়ি ছিল। দুটি লিফট ছিল। আগুন লাগার পর মানুষ নামতে পারেনি।'
বার বার নাম আসা কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁর ব্যবস্থাপক আবদুল হালিম বলেছেন, তাদের দোকান থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়নি।
তিনি বলেন 'আগুনের সূত্রপাত নিচ তলার চুমুক রেস্টুরেন্ট থেকে। আমি নিজে দেখেছি সেখান থেকেই প্রথমে আগুনের ধোঁয়া বেরুচ্ছে। যেভাবে আমরা মিডিয়ায় দেখলাম যে, কাচ্চি ভাই থেকে এই করছে, হেই করছে। কাচ্চি ভাইয়ের ওখানে আপনারা উঠে দেখুন এখনো কাচ্চি ভাইয়ের কিচেন যেটা পেছনে, সেই কিচেন ঠিক আছে। আগুনের চিহ্ন পাবেন না। আগুন লাগছে সামনে। তাহলে কাচ্চি ভাইয়ের কিচেন থেকে আগুন কীভাবে লাগল আপনারা বলেন?'
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের বলেন, গ্রিন কোজি কটেজ বাণিজ্যিক ভবন হিসেবে ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে। তবে ভবনে থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর বৈধ ট্রেড লাইসেন্স আছে কি না তাও দেখা হবে। সূত্র : বিডিনিউজ