দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর দল পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেছে বিএনপি। শুরুতে বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কমিটি ভেঙে দিয়ে নতুন আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
শুক্রবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রাশেদ ইকবাল খান এবং সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের নেতৃত্বাধীন বিদ্যমান কমিটি বিলুপ্ত করে সাত সদস্যবিশিষ্ট নতুন আংশিক কমিটি করা হয়েছে। রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে সভাপতি এবং নাসির উদ্দীন নাসিরকে সাধারণ সম্পাদক করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে। সভাপতি রাকিব আগের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে। সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন নাসির আগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী জেলায়। আর নতুন সাংগঠনিক সম্পাদক আমান আগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব ছিলেন। তার গ্রামের বাড়ি বরগুনা জেলায়। বর্তমানে তিনজনই ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে মাস্টার্স করছেন।
এছাড়া নবগঠিত কমিটিতে সিনিয়র সহ-সভাপতি করা হয়েছে আবু আফসান মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শ্যামল মালুম, দপ্তর সম্পাদক (সহ-সভাপতি পদমর্যাদা) হয়েছেন জাহাঙ্গীর আলম ও শরিফ প্রধান শুভকে
করা হয়েছে প্রচার সম্পাদক (যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদমর্যাদা)।
ছাত্রদলের নতুন সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব ও সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দীন নাসির তাদের ওপর আস্থা রাখায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অভিনন্দন জানান। তার আস্থার প্রতিদান দেবেন জানিয়ে বলেন, আগামীর ছাত্রদল হবে জিয়া পরিবারের বিশ্বস্ত হাতিয়ার, আগামীর ছাত্রদল হবে এদেশের গণমানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রধান হাতিয়ার।
এদিকে নেতাকর্মীদের নিয়ে সন্ধ্যায় নবগঠিত কমিটির নেতারা নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যান। এ সময় কার্যালয়ের সামনে নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা ফুল ও করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান।
এদিকে ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে। একই বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এ বি এম ইজাজুল কবির রয়েল এবং সাধারণ সম্পাদক আরিফুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন বিদ্যমান কমিটি বিলুপ্ত করে ৭ সদস্য বিশিষ্ট নতুন আংশিক কমিটি অনুমোদন করা হয়েছে। নবগঠিত কমিটিতে গণেশ চন্দ্র রায় সাহসকে সভাপতি এবং নাহিদুজ্জামান শিপনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে। এছাড়াও মাসুম বিলস্নাহ সিনিয়র সহ-সভাপতি, আনিসুর রহমান খন্দকার অনিক সহ-সভাপতি, নাছির উদ্দীন শাওন সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, শামীম আক্তার শুভ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং নূর আলম ভুইয়া ইমনকে সাংগঠনিক সম্পাদক করা হয়।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচন ঠেকানোর মিশনে ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি এখন নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর পরিকল্পনা করেছে। দল গোছানোর দিকে মনোযোগ দিতে চাচ্ছে তারা। এ নিয়ে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা সিরিজ বৈঠক করছেন। নীতিনির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, দলের স্থায়ী কমিটি, নির্বাহী কমিটির শূন্য পদসহ দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পুনর্গঠন করা হবে। তবে আপাতত কেন্দ্রীয় কাউন্সিল হবে না।
নেতারা মনে করছেন- দল পুনর্গঠন হলে ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতারা মূল্যায়িত হবেন। হতাশা কেটে যাবে, নেতাকর্মীরা চাঙা হবেন। নতুন নেতৃত্ব আসলে গতিশীলতা ফিরবে। তখন আন্দোলনে নামতে পারবেন তারা। দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে বিএনপি বছরের অধিক সময় ধরে রাজপথে আন্দোলন করলেও চূড়ান্ত সফলতা আসেনি। বিএনপির বর্জন ও আন্দোলনের মধ্যেই গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে টানা চতুর্থ বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। নির্বাচনের পরই আন্দোলনে ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানে নামে বিএনপির হাইকমান্ড। দলটির মূল্যায়নে উঠে আসে, গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসংগঠনগুলো রাজপথে কার্যকর ও প্রত্যাশিত ভূমিকা না রাখায় নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী আন্দোলনে চূড়ান্ত সাফল্য আসেনি। এমন মূল্যায়নের ভিত্তিতে আগামীর আন্দোলন সামনে রেখে দাঁড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে নিষ্ক্রিয় সংগঠনগুলো পুনর্গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন হাইকমান্ড। এরই মধ্যে এ পুনর্গঠনের রূপরেখাও চূড়ান্ত করা হয়েছে। এর অংশ হিসেবে আন্দোলন-সংগ্রামে বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার কমিটি ভেঙে নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে।
জানা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, মহিলা দল, কৃষক দল, মৎস্যজীবী দল, তাঁতী দলসহ সব অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন পুনর্গঠনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপির হাইকমান্ড। এসব সংগঠনে আগামীতে কাদের নেতৃত্বে আনা যায় এবং কমিটির বর্তমান শীর্ষ নেতাদের কোথায় পদায়ন করা হবে- সেগুলো নিয়ে এখন দলের ভেতরে কাজ চলছে। এই বিষয়গুলো চূড়ান্ত হলেই পর্যায়ক্রমে প্রতিটি কমিটিই বিলুপ্ত করে নতুন নেতৃত্বে অঙ্গ সংগঠনগুলো সাজানো হবে। অবশ্য দীর্ঘ সময় ধরে চলবে এই প্রক্রিয়া।
সূত্রের দাবি, বিএনপির অঙ্গ সংগঠন পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শেষ হলে মূল দল পুনর্গঠনে হাত দেওয়া হতে পারে। নতুন লোক দিয়ে দলের স্থায়ী কমিটিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণ করা হবে। স্থায়ী কমিটিতে পাঁচটিসহ কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির প্রায় ১৩০টি পদ এখন শূন্য। তবে অঙ্গসংগঠন পুনর্গঠনের মধ্যেও এই প্রক্রিয়া চলতে পারে। সম্প্রতি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির দুটি শূন্যপদ পূরণ করা হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র এক নেতা জানান, বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করার মতো পরিস্থিতি নেই। তাই এখন স্থায়ী কমিটি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির শূন্যপদ পূরণের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণসহ অন্যান্য পদসহ অঙ্গ দল পুনর্গঠনের জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এরই মধ্যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশেও দলের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন এমন পরীক্ষিত ও ত্যাগী প্রবীণ নেতার পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত কম বয়সি নেতাদেরও দায়িত্বশীল পদে স্থান দেওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। শিগগিরই শূন্যপদগুলো ধারাবাহিকভাবে পূরণ করা হবে।
সূত্র মতে, বিগত আন্দোলনে অন্যান্য কমিটির চেয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির পারফরম্যান্সেও অসন্তুষ্ট হাইকমান্ড। দলের গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি শাখার শীর্ষ নেতাদের কার্যক্রমে প্রায় সবাই হতাশ। তাই রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ দুটি কমিটি পুনর্গঠন নিয়ে ভাবছে দলের নীতিনির্ধারণী মহল।
দলে পুনর্গঠন প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, দল পুনর্গঠন একটি চলমান প্রক্রিয়া। তা সবসময় হয়ে থাকে। এ নিয়ে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়। এখনো হচ্ছে।