শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর

স্বর্ণ পাচারের নিরাপদ রুট

জড়িত বিমানবন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই হ চার বছরে ২০০ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে কাস্টমস

প্রকাশ | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সঞ্জীব নাথ, চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে থামছে না অবৈধ স্বর্ণ পাচার। একের পর এক আসছেই স্বর্ণের চোরাচালান। এর মধ্যে কিছু স্বর্ণের চালান ধরা পড়লেও তার অনেকগুণ বেশি স্বর্ণের চালান বেরিয়ে যাচ্ছে এই বিমানবন্দর দিয়ে। বিমানবন্দরের উঁচুস্তরের অনেকেই এই স্বর্ণ চোরাচালানের সাথে জড়িত থাকায় স্বর্ণ পাচারকারীদের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, ওমান ও সৌদি আরবের প্রবীণ প্রবাসীদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। প্রবাসীদের অভিযোগ, শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে যে সব স্বর্ণের চোরাচালান ধরা পড়ে তা খুবই নগণ্য। কম স্বর্ণ হিসেবে যারা লুকিয়ে আনে সে সবের কিছু চালান ধরা পড়ছে। কিন্তু নিকু্যজিশন বা গোপন চুক্তির মাধ্যমে যারা স্বর্ণের চালান পাচার করে তার একটিও ধরা পড়ে না। এসব চালানগুলো ধরা পড়া চোরাই স্বর্ণের চালানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি বড়। আর এসব স্বর্ণ পাচারের সাথে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বড় বড় রাঘব বোয়াল, ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের অফিসার জড়িত। যাদের ঈশারায় বিমান থেকে এসব স্বর্ণের চালান বেরিয়ে যেতে সহায়তা করে বিমানবন্দরের নিরাপত্তাকর্মী, আনসার, পরিচ্ছন্নকর্মী, ট্রলি শ্রমিক থেকে সাধারণ শ্রমিকরা। গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়োজিত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. এম জেড এ শরীফ মিঠুর কাছ থেকে চারটি স্বর্ণের বার জব্দ করার ঘটনায় ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা হয় বলে জানান প্রবাসীরা। প্রবাসীরা আরও জানান, এই স্বর্ণের চোরা চালান পাচার সুবিধার কারণে নিম্ন থেকে উঁচু শ্রেণির অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের চাকরির পোস্টিং নেন। বিষয়টি স্বীকার করেছেন বিমানবন্দরে কর্মরত আনসার কামান্ডার রহিম উদ্দিন শাহ। তিনি বলেন, এখানে পোস্টিং নিতে আনসার কামান্ডারদের ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। ঘুষ দিয়ে পোস্টিং নেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা। তবে কত টাকা ঘুষ দিয়ে তিনি পোস্টিং নিয়েছেন সে বিষয়ে মুখ খোলেননি তিনি। তবে তিনি বলেন, বিমানবন্দরের চাকরি যেকোনো জায়গার চেয়ে ভালো। এখানে আয়ও বেশি। আয় বেশি আসে স্বর্ণ পাচার থেকে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিভাগের তথ্যমতে, গত বুধবার সকালে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে টর্চলাইটের ভেতর থেকে ১ কেজি ৬২০ গ্রাম স্বর্ণ জব্দ করেছেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। এটিই সবশেষ স্বর্ণের চোরাচালান। এই চালানে আটক স্বর্ণের বাজারমূল্য ১ কোটি ৬২ লাখ টাকার মতো। ওই ঘটনায় সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে আসা যাত্রী জাহাঙ্গীর আলমকে আটক করা হয়েছে। কাস্টম হাউসের সহকারী কমিশনার আলিফ রহমান জানান, জাহাঙ্গীর ফ্লাই দুবাইয়ের একটি ফ্লাইটে করে সকাল সাড়ে ৮টায় চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। তার আচরণ সন্দেহজনক মনে হলে তলস্নাশি করে তার সঙ্গে থাকা একটি টর্চলাইট থেকে এসব স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়। এসব স্বর্ণ ব্যাটারির পরিবর্তে বিশেষভাবে লুকিয়ে আনা হয়েছিল। এর আগে ১৬ ফেব্রম্নয়ারি দিবাগত রাত পৌনে ৯টার দিকে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ওমান এয়ারের একটি ফ্লাইটে মেলে ৬৪ পিস স্বর্ণের বার। এসব স্বর্ণের ওজন ৭ কেজি ৪০০ গ্রাম। যার বাজার মূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। ফ্লাইটটি বিমানবন্দর অবতরণের পর তলস্নাশির সময় বিমানের যাত্রী বসার সিটের পেছনে লুকানো স্বর্ণের বারগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পান শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আবদুল মতিন তালুকদার বলেন, গোপন সূত্রে খবর পেয়ে ওমান থেকে আসা ওমান এয়ারের ডবিস্নওয়াই ৩১৩ ফ্লাইটে তলস্নাশি চালিয়ে স্বর্ণের বারগুলো জব্দ করতে সক্ষম হন শুল্ক গোয়েন্দারা। ফ্লাইটটির ৩৫-এফ সিটের পেছনের দিকে চারটি দন্ডাকৃতির বস্তুর মধ্যে স্বর্ণের বারগুলো বিশেষভাবে লুকানো ছিল। প্রতিটি দন্ডে ১৬টি করে মোট ৬৪টি স্বর্ণের বার পাওয়া যায়। স্বর্ণের বারগুলোর মোট ওজন ৭ কেজি ৪০০ গ্রাম। যার বাজার মূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। বিমানের ওই সিটে কোনো যাত্রী না থাকায় কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি বলে জানান আবদুল মতিন তালুকদার। \হ২৬ জানুয়ারি সকালে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কনভেয়ার বেল্টে পাওয়া সিগারেটের প্যাকেট থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ১৪টি স্বর্ণের বার জব্দ করেছে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা। যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। আরব আমিরাতের শারজাহ থেকে এয়ার এরাবিয়া এয়ারলাইন্সের এ৯-৫২৬ যোগে আসা কোনো যাত্রী এসব স্বর্ণের বার আনতে পারে বলে জানান শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের পরিচালক উইং কমান্ডার তসলিম আহমেদ। তবে ওই যাত্রীকে শনাক্ত করতে না পারায় আটক করা সম্ভব হয়নি। উদ্ধার করা স্বর্ণ বিমানবন্দর শুল্ক গোয়েন্দার কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এর আগে ১৩ জানুয়ারি সকাল সাড়ে ৮টার পর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে শারজাহ থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে সাড়ে ৪ কেজি স্বর্ণ জব্দ করা হয়েছে। এসব স্বর্ণের আনুমানিক মূল্য ৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭১ হাজার ৩৬০ টাকা। জব্দ হওয়া এসব স্বর্ণের মূল্যের পুরোটাই সরকারি রাজস্ব হিসেবে জমা হয়েছে। এভাবে নতুন বছরের শুরু থেকে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে স্বর্ণের চোরা চালান বেড়ে গেছে বলে জানায় কাস্টমসের একাধিক সূত্র। কাস্টমসের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে গত চার বছরে অন্তত ২০০ কেজি স্বর্ণ জব্দ করেছে কাস্টমস। এর মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে জব্দ করা স্বর্ণের পরিমাণ ৩৬ কেজি, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৭৮ কেজি, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২০ কেজি এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩৮ কেজি। এসব স্বর্ণের দাম ১১০ কোটি টাকার বেশি। চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে একের পর এক স্বর্ণের চালান আসার বিষয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের এয়ারপোর্ট ও এয়ারফ্রেইট ইউনিটের সহকারী কমিশনার মো. মহিউদ্দিন পাটোয়ারী বলেন, কাস্টমসের তৎপরতার কারণেই একের পর স্বর্ণের চালান জব্দ হচ্ছে। বিশেষ কায়দায় স্বর্ণ আনার পরও আটক করা হচ্ছে। কাস্টমসের পক্ষ থেকে কোনো সফট টার্গেট নেই। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে গত ১৫ নভেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দেওয়া এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিমানবন্দরে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকে স্বর্ণ পাচারসহ নানা দুর্নীতিতে জড়িত। বিষয়টি সরেজমিন তদন্ত করে ১৫ দিনের মধ্যে ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও চোরাচালান থামছে না। এই বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উইং কমান্ডার তসলিম আহমেদ বলেন, বিষয়টি ছোটখাটো ব্যাপার নয়। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া যেমন কঠিন, তেমন সময়সাপেক্ষ। তবে বিষয়টি নিয়ে আমরা ভাবছি। কীভাবে পদক্ষেপ নিলে ভালো হয় সেটা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে।