দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরে সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের নতুন কোনো কর্মসূচিতে নেই বিএনপি। অন্যদিকে নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ প্রশ্ন তুললেও তা দৃশ্যত আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য নতুন কোনো চাপ তৈরি করতে পারেনি। এই পরিস্থিতিতে নেতাকর্মীদের পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে, দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে পরিবর্তন না এনে আন্দোলনে গেলে আবারো ব্যর্থ হতে হবে। ফলে আন্দোলনকে নতুনভাবে সংগঠিত করার জন্য স্থায়ী কমিটিসহ দায়িত্বশীল বিভিন্ন পদে পুনর্গঠনের চাপ বাড়ছে।
জানা গেছে, নির্বাচন-পরবর্তী দলকে সাংগঠনিকভাবে ঢেলে সাজানোর ভাবনা শুরু হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির শূন্যপদগুলো পূরণের আলোচনা চলছে বেশ জোরেশোরে। রদবদলের আলোচনায় আছে জিয়া পরিবারের সদস্যরাও।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নেতাকর্মীদের বিশ্লেষণে সর্বশেষ আন্দোলন ব্যর্থতার জন্য সাংগঠনিক দুর্বলতা ও বিদেশনির্ভরতার বিষয়টি সবার সামনে এসেছে। এর মধ্যে সাংগঠনিক বিপর্যয়ের জন্য দেশব্যাপী তারেক রহমানের সাংগঠনিক বলয় দায়ী এমন মতও আছে। তাদের মতে, ২০১৮ সালে দলের হাল ধরার পর থেকে বিএনপিতে একক কর্তৃত্ব তৈরি করতে গিয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নিজের পছন্দে নেতাদের দিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে কমিটি গঠন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। ফলে অনেক কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে রাজনীতি করা অনেক ত্যাগী নেতা গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে বাদ পড়েন। বাদ পড়া নেতাদের অনুসারীরাও নতুন কমিটি থেকে ছিটকে পড়েন। ফলে সাংগঠনিক গতিশীলতা কমতে থাকে, দলে এক ধরনের স্থবিরতা তৈরি হয়। অন্যদিকে তারেক রহমান যাদের নেতৃত্বে আনেন তাদের বেশির ভাগই স্থানীয়ভাবে যোগ্য ও দক্ষ নন বলে দলে অভিযোগ আছে। কিন্তু দেশব্যাপী তার বিশ্বস্ত নেতা এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতারা সরকার 'ফেলে' দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন এমন ধারণা দেন তারেক রহমানকে। কিন্তু আন্দোলনের মাঠে তাদের তৎপরতা ছিল না বললেই চলে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক চাপ এবং সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণে শেষ পর্যন্ত বিএনপির মূল নেতৃত্ব থেকে সরে যেতে পারেন জিয়া পরিবারের সদস্যরা দলটিতে এমন আলোচনাও আছে। বলাবলি হচ্ছে, তারেক রহমান বিএনপির নির্বাহী দায়িত্ব ছেড়ে দিতে পারেন। এ নিয়ে সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখনও যারা সক্রিয়ভাবে মাঠে থেকে বিএনপির রাজনীতি করছেন তাদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব বাছাই করার বিষয়েও আলোচনা করেছেন। এমন কথা চাউর আছে জিয়া পরিবারের সদস্যদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, জিয়া পরিবারে বিষয়ে আলোচনাটি স্পর্শকাতর হওয়ায় এনিয়ে প্রায় সব নেতাকর্মীই সতর্কতার সঙ্গে গোপনীয়তা বজায় রেখে কথা বলছেন। এর বাইরে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কমিটি পুনর্বিন্যাসের বিষয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা চলছে। দলটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি থেকে কয়েকজনকে বাদ এবং কয়েকজনকে অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ে ভাবছেন তারা।
জানা গেছে, বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল করার মতো পরিস্থিতি নেই। তাই এখন স্থায়ী কমিটি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটির শূন্যপদ পূরণের বিষয়ে ভাবা হচ্ছে। স্থায়ী কমিটির শূন্যপদ পূরণসহ অন্যান্য পদসহ অঙ্গ দল পুনর্গঠনের জন্য ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে এরই মধ্যে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। প্রতিকূল পরিবেশেও দলের মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছেন এমন পরীক্ষিত ও ত্যাগী প্রবীণ নেতার পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত কম বয়সি নেতাদেরও দায়িত্বশীল পদে স্থান দেওয়ার বিষয়টি সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে। শিগগিরই শূন্যপদগুলো ধারাবাহিকভাবে পূরণ করা হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির পাশাপাশি সারাদেশের জেলা, মহানগরের পাশাপাশি বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির শূন্যপদগুলো পর্যায়ক্রমে পূরণ করা হবে।
জানা গেছে, বিএনপি সর্বশেষ ২০১৬ সালের মার্চে কাউন্সিল করে। ওই বছরের আগস্টে ১৭ সদস্যের স্থায়ী কমিটি ঘোষণা করা হয়। বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে পদ রয়েছে ১৯টি। তখন থেকেই দুটি পদ শূন্য রয়েছে। ৪ নেতার মৃতু্য, একজনের পদত্যাগ, তিন নেতার অন্তর্ভুক্তির পরেও বর্তমানে পাঁচটি পদ খালি রয়েছে। এর মধ্যে সাজা ও অসুস্থতার কারণে অনেকে সক্রিয় নেই। কেউ নানা আইনি জটিলতার কারণে দেশে আসতে পারছেন না। এখন বৈঠকে ৮ থেকে ১০ জনের বেশি থাকেন না। কমিটিতে থাকলেও বার্ধক্য, অসুস্থতাসহ নানা কারণে কয়েকজন নেতাকে কখনো বৈঠকে পাওয়া যায় না। সঙ্গত কারণে নীতিনির্ধারণী ফেরামে নতুন নেতার অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা দল প্রচন্ডভাবে অনুভব করছে।
দলীয় সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারেন এমন কয়েকজন নেতার বিষয়ে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে। তারা হলেন- সিনিয়র নেতা আব্দুলস্নাহ আল নোমান, মেজর হাফিজ উদ্দিন আহাম্মদ (অব.), বরকতউলস্না বুলু, মো. শাহজাহান, আবদুল আউয়াল মিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরী, এ জেড এম জাহিদ হোসেন, আহমেদ আযম খান, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, শামসুজ্জামান দুদু ও রুহুল কবীর রিজভী। গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের মধ্যে মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল ও জহির উদ্দিন স্বপনের নামও আলোচনায় আছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপিতে স্থায়ী কমিটি বরাবরই একটি আকর্ষণীয় ও মর্যাদাসম্পন্ন পদ। আজীবন বিএনপির রাজনীতি করা পোড় খাওয়া নেতাদের টার্গেট থাকে শেষ জীবনে হলেও স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া। দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে এ ফোরামে সাংগঠনিকভাবে যোগ্য, পরীক্ষিত, ত্যাগী ও দলে তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদেরই স্থান হয়। তাই প্রায় সব সিনিয়র নেতার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়া। এ কমিটি নির্বাচনের প্রার্থী চূড়ান্ত, কর্মসূচি প্রণয়ন থেকে শুরু করে সার্বিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের কাজগুলো করে। স্থায়ী কমিটির সুপারিশের আলোকেই বেশিরভাগ সময় বিএনপির শীর্ষ নেতারা সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন।
দলে পুনর্গঠন আলোচনার বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান বলেন, দল পুনর্গঠন একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া। দলের নীতিনির্ধারণী পদসহ অন্য পদগুলোতে কেউ অন্তর্ভুক্ত হবেন কি না, কমিটিতে কোনো পরিবর্তন আসবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের।