সেচে বিদু্যৎ-জ্বালানি সংকটের শঙ্কা

প্রকাশ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
ফেব্রম্নয়ারি থেকে মে- এই চার মাস এবার বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত হবে এবং তাপমাত্রা বেশি থাকবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা ও আমেরিকান আবহাওয়া মডেল বিশ্লেষণ করে এমনটাই আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। ফলে শস্য ক্ষেতে পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন হবে। অথচ এ কাজে প্রয়োজনীয় বিদু্যৎ ও জ্বালানির স্বাভাবিক সরবরাহ নিয়ে এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে নানামুখী শঙ্কা। সেচ মৌসুমের প্রথম মাস ফেব্রম্নয়ারি কোনোভাবে পার হতে চললেও মার্চের মাঝামাঝিতে শুরু হওয়া রমজান এবং গরমের কারণে এ সংকট আরও গভীর হবে বলে বিদু্যৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা আগাম আভাস দিয়েছেন। এছাড়া ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় এবং আগের তুলনায় ফসল উৎপাদনে আগের চেয়ে বেশি পানির প্রয়োজন হওয়ায় সেচ কাজে বেশি বিদু্যৎ-জ্বালানির প্রয়োজন হবে। যা সেচের পিক-মৌসুমে কতটা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে তা নিয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তাদের ভাষ্য, ফেব্রম্নয়ারির শেষভাগে এসে এখনো সেভাবে গরম না পড়লেও দেশের বিভিন্ন জায়গায় লোডশেডিং শুরু হয়েছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে দিনরাত মিলিয়ে ৩/৪ বার করে বিদু্যতের আসা-যাওয়ার খেলা চলছে। জমিতে সামান্য সেচ দিতে বিদু্যতের জন্য ৪/৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তাই কৃষকরা অনেকে ডিজেল পুড়িয়ে সেচপাম্প চালু রাখছেন। এতে উৎপাদন খরচ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বাড়ছে। এর ওপর জমিতে আগের চেয়ে বেশি সেচের পানি প্রয়োজন হওয়ায় এবং ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনে বেশি সময় লাগায় বাড়তি খরচের চাপ আরও বাড়বে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদু্যৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে এ বছর সেচ কার্যক্রম গতবারের চেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হতে পারে। এতে হাজার হাজার বিঘা জমিতে ফসল বপন বিঘ্নিত হবে এবং উৎপাদনও উদ্বেগজনকভাবে কমবে। ডলার সংকটের মধ্যে বিদু্যৎকেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি নিয়ে অনিশ্চয়তায় এই আশঙ্কা আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। বিদু্যৎ খাতে বিপুল পরিমাণ বকেয়া 'মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা' হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন তারা। কৃষি খাত পর্যবেক্ষকদের ধারণা, গরম, রমজান এবং সেচ মৌসুমের কারণে আগামী মার্চ মাস থেকেই পালস্না দিয়ে বাড়বে বিদু্যতের চাহিদা। বিদু্যৎ বিভাগের পূর্বাভাস, আগেরবারের তুলনায় প্রায় ২ হাজার মেগাওয়াট বেড়ে চলতি মৌসুমে বিদু্যতের সর্বোচ্চ চাহিদা দাঁড়াতে পারে ১৭ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটে। গত মৌসুমে বিদু্যতের চাহিদা ছিল ১৬ হাজার মেগাওয়াট। তবে ১১ শতাংশের বেশি বিদু্যৎ চাহিদা বাড়লেও জ্বালানি সংস্থানে রাতারাতি বড় কোনো পরিবর্তন দৃশ্যমান নয়। এর ওপর আরেক ভাবনার কারণ ডলার নিয়ে টানাটানি। এবার সেচ মৌসুমে বিদু্যৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে প্রয়োজন ১ লাখ ৫৫ হাজার টন ফার্নেস অয়েল, ১৫ হাজার ৬০০ টন ডিজেল এবং দৈনিক কয়লার চাহিদা ৩০ হাজার টন। যার জন্য লাগবে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার ছাড়। এছাড়া এবার বিদু্যৎ বিভাগের দৈনিক চাহিদা ১৫৪ থেকে ১৭৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস। যেখানে গতবার বিদু্যৎ খাতে ১১০ থেকে ১২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করতেই জ্বালানি বিভাগকে হিমশিম খেতে হয়। অভ্যন্তরীণ খাতে অপর্যাপ্ততা এবং সংকটময় বৈশ্বিক বাস্তবতায় বর্তমান পরিস্থিতি কতটা সামাল দেওয়া সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দিহান সংশ্লিষ্টরা। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, এলএনজির ওপর যদি ব্যাপকভাবে নির্ভর করা হয় তাহলে যে আর্থিক চাপ পড়বে সেটি বাংলাদেশের এই ডলার সংকটের সময়ে জ্বালানি বিভাগকে বড় রকমের অসুবিধার মধ্যে ফেলবে। ফলে আসন্ন গ্রীষ্মে বিদু্যৎ সংকট আরও বাড়বে। এতে স্বাভাবিক সেচকার্য পরিচালনা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েই গেছে। এদিকে সেচ মৌসুমে বিদু্যৎ ও জ্বালানির সংকট নিয়ে উদ্বিগ্ন খোদ সরকারের নীতিনির্ধারকরাও। তাই গরমে বিদু্যৎ সাশ্রয়ী কার্যক্রম চালু এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিদু্যৎ ব্যবস্থাপনা সমন্বয় কমিটির কার্যক্রম জোরদার করতে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সম্প্রতি জেলা প্রশাসকদের কাছে মন্ত্রিপরিষদের পাঠানো এক চিঠিতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রে এ তথ্য মিলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে মোট সেচ সংযোগের সংখ্যা ৪,৮৭,৮৫১টি এবং অপেক্ষমান আবেদন সংখ্যা ৯,৪৩২টি। শুধু সেচের জন্য জানুয়ারি ২০২৪-এ ৩৪৭ মেগাওয়াট বিদু্যতের চাহিদা থাকলেও ফেব্রম্নয়ারিতে তা বেড়ে ৮৬৫ মেগাওয়াটে গিয়ে ঠেকেছে। আর মার্চে ১ হাজার ৯৪৯ মেগাওয়াট, এপ্রিলে ২ হাজার ৫৯০ মেগাওয়াট এবং মে মাসে ২ হাজার ৫৯০ মেগাওয়াট বিদু্যতের প্রয়োজন হবে। এছাড়া সেচ মৌসুমে গ্যাসের চাহিদা ১ হাজার ৭৬০ এমএমসিএফডি এবং নূ্যনতম ১ হাজার ৫৪০ এমএমসিএফডি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফার্নেস অয়েলের চাহিদা ১ লাখ ৫৪ হাজার ৯৫০ টন এবং ডিজেলের চাহিদা ১৫ হাজার ৬০০ টন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এদিকে কৃষকরা জানান, দেশে ইতোমধ্যে বোরো আবাদ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। গরম পড়তেই জমিতে সেচের প্রয়োজন হচ্ছে। তবে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যাওয়ায় বোরো আবাদে সেচের সময় বাড়ছে। তবে লোডশেডিংয়ের কারণে টানা দীর্ঘ সময় সেচযন্ত্র চালিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে গরমে লোডশেডিং বাড়লে পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে তা নিয়ে কৃষকরা উদ্বিগ্ন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ভূগর্ভস্থ পানির মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারে প্রতি বছর পানির আধার এলাকাভেদে ৩-৮ মিটার নেমে যাচ্ছে। যে পরিমাণ পানি উত্তোলিত হচ্ছে বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে প্রকৃতি থেকে ওই পরিমাণ পানি রিচার্জ হচ্ছে না। বৃষ্টির পানিতে ভূগর্ভস্থ পানির আধার অনেকটা পূর্ণ হয়। কিন্তু পানির স্তর যত নিচে নেমে যাচ্ছে বোরোর উৎপাদন খরচ ততই বাড়ছে। বিশেষ করে হাইব্রিড ও উচ্চ ফলনশীল (উফশী) আবাদে শুধু সেচের জন্য কৃষককে ব্যয় করতে হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ অর্থ। বাকি অর্থ ব্যয় হয় সার বীজ-কীটনাশকসহ অন্যান্য উপকরণ ও পরিচর্যায়। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) তথ্যানুযায়ী দেশে বোরো মৌসুমে সচল থাকে অন্তত ২৫ লাখ অগভীর নলকূপ (শ্যালো নামে অধিক পরিচিত)। নিকট অতীতে ওই নলকূপগুলোতে ১৫ থেকে ২০ ফুট নিচেই পানি মিলত। কিন্তু বর্তমানে ২৮ থেকে ৩০ ফুট নিচেও আগের মতো নিরবচ্ছিন্নভাবে পানি মিলছে না। ফলে অনেক কৃষক ৫/৬ ফুট মাটি খুঁড়ে পাম্প বসিয়ে পানি উত্তোলন করছেন। বিএডিসির আরেক হিসেবে বলা হয়েছে, দেশে প্রায় ১৭ লাখ অগভীর নলকূপ ডিজেলে চলে আর বিদু্যতে চলে প্রায় ৮ লাখ। তাছাড়া ১২ হাজার গভীর নলকূপ ডিজেলে চলে আর বিদু্যতে চলে ৩০ হাজার গভীর নলকূপ। কৃষিবিদরা বলছেন, অগভীর ও গভীর মিলিয়ে যে ১৭ লাখ ১২ হাজার নলকূপ ডিজেলে চলে তার জ্বালানি সরবরাহ আগামীতে কতটা স্বাভাবিক রাখা যাবে তা নিয়ে কৃষকরা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। একই অবস্থা গভীর-অগভীর ৮ লাখ ৩০ হাজার পাম্পের বিদু্যৎ সরবরাহ নিয়েও। ডিজেল ও বিদু্যৎ সংকটে এবার সেচের মাধ্যমে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া যাবে না আশঙ্কা থেকে অনেক কৃষক তাদের সব জমিতে ফসল রোপণ থেকে বিরত রয়েছেন। কোনো কোনো কৃষক তার মোট জমির এক-তৃতীয়াংশের বেশি অনাবাদি রাখছেন বলেও তথ্য পাওয়া গেছে। কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বর্তমানে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে ৩ হাজার ৫শ' লিটার করে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার হচ্ছে। ৩৯ বছর আগে (১৯৮১ সালে) এক কেজি ধান উৎপাদনে সেচের পানির দরকার হতো প্রায় ২ হাজার লিটার। আর ১০ বছর আগে প্রয়োজন হতো প্রায় ৩ হাজার লিটার পানি। গত বছরের হিসেবে দেখা গেছে প্রতি কেজি ধান উৎপাদনে সেচের পানির দরকার হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার লিটারেরও বেশি। বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশই ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে দিয়ে সারফেস ওয়াটার ব্যবহারে জোর দিয়েছে। ভারত, চীন, ভিয়েতনামে সেচ কাজে ভূগর্ভস্থ পানি সর্বোচ্চ মাত্রায় সীমিত করা হয়েছে। আইলের মাধ্যমে সেচের পানি সরবরাহ করলে মাটি অনেকটা পানি শুষে নেয়। এজন্য অপচয় রোধে ড্রেনেজ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন হয়েছে। ভারত ও ভিয়েতনাম ধান উৎপাদনে বিশ্বে অনেকদূর এগিয়েছে। বাংলাদেশও ওই পথ ধরেই এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনো তা ধীরগতিতে চলছে। এদিকে বিদু্যৎ ও জ্বালানি সংকটে সেচ কাজ ব্যাহত হওয়া নিয়ে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা জানান, বিদু্যৎ চাহিদা মেটাতে উৎপাদন সক্ষমতা থাকলেও ঘাটতি আছে বিদু্যৎ উৎপাদনের জন্য কয়লা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও জ্বালানি তেলের (ডিজেল-ফার্নেস) সরবরাহে। চাহিদামতো জ্বালানি না পাওয়ায় গত দুই বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে ব্যাপক লোডশেডিং করতে হয়েছে। এ বছর সংকট আরও বাড়বে। ফলে ব্যাপক লোডশেডিংয়ের কারণে সেচের পানি সরবরাহ কতটা স্বাভাবিক রাখা যাবে তা নিয়ে উৎকণ্ঠা বাড়ছে। বিদু্যৎ বিভাগের নীতি-গবেষণা সংস্থা পাওয়ার সলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইনও একই ধরনের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, জ্বালানির কারণে পরিকল্পনামতো উৎপাদন করা না গেলে লোডশেডিং হতে পারে। ফলে সেচকাজ স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বাধাগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যাচ্ছে। বিদু্যৎ খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, সাধারণত মার্চ থেকে বিদু্যতের চাহিদা বাড়তে থাকে। এটি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত চলে। মাঝে বর্ষার কারণে জুন-জুলাইয়ে চাহিদা একটু কমে যায়। আর সর্বোচ্চ বিদু্যৎ চাহিদা হয় এপ্রিলে। আর এ সময় গ্যাস থেকে আসে ৬ হাজার, জ্বালানি তেল থেকে সাড়ে ৫ হাজার, কয়লা থেকে আড়াই হাজার ও আমদানি থেকে ১ হাজার বিদু্যৎ আসে। কিন্তু কয়লা থেকে বিদু্যৎ উৎপাদন স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হলেও সরবরাহ ঘাটতির কারণে গ্যাস ও জ্বালানিভিত্তিক বিদু্যৎকেন্দ্রগুলো কতটা উৎপাদন সক্ষম রাখা যাবে তা বলা মুশকিল। তাই সেচে বিদু্যৎ ও জ্বালানি সংকট হওয়ার জোরালো শঙ্কা রয়েছে।