চন্দ্রাভিযানে নতুন ইতিহাস তৈরি করল যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি। হিউস্টনভিত্তিক ইনটিউটিভ মেশিনস নামে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটির প্রথম বাণিজ্যিক রোবট 'ওডিসিয়াস' সফলভাবে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করেছে।
আর এর মধ্য দিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০ বছরের বেশি সময়ের অনুপস্থিতির অবসান ঘটল।
১৯৭২ সালে অ্যাপোলো-১৭ মিশন ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবশেষ চন্দ্রাভিযান।
সিএনএন জানিয়েছে, ফ্লোরিডায় নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে যাত্রা শুরু করে হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে মানুষবিহীন মহাকাশযানটি চাঁদের উপরিভাগে পৌঁছায় স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়।
সিএনএনসহ যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, 'ওডি' বা 'আইএম-১' ডাকনামের রোবটটিকে চাঁদে মাটিতে স্থাপনে কয়েক মিনিট সময় লাগলেও কিছুক্ষণ পর থেকেই সেটি ইনটিউটিভ মেশিনসের নিয়ন্ত্রণকক্ষে সংকেত পাঠাতে শুরু করে।
প্রতিষ্ঠানটির ফ্লাইট ডিরেক্টর টিম ক্রেইন এরই ঘোষণা দেন, 'সন্দেহাতীতভাবে এখন আমরা নিশ্চিত করতে পারি, আমাদের যন্ত্রটি চাঁদের পিঠে পৌঁছেছে এবং আমরা সংকেত পাঠাতে পারছি।' তার এই ঘোষণার পরপরই উলস্নসিত ইনটিউটিভ মেশিনসের কর্মীরা হাততালি দিয়ে ওঠেন।
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র নাসার জন্য এই অভিযানটি গুরুত্বপূর্ণ। চাঁদে গবেষণা চালাতে ছয়টি বৈজ্ঞানিক যন্ত্র স্থাপনের জন্য ওডিসিয়াসে জায়গা কিনেছিল নাসা।
'ওডিসিয়াস' চাঁদে অবতরণের পরপরই নাসার প্রশাসক বিল নেলসন ইনটিউটিভ মিশনসকে অভিনন্দন জানিয়ে এ ঘটনাকে 'বিজয়' বলে অভিহিত করেছেন।
নেলসন বলেন, চাঁদে ফিরেছে যুক্তরাষ্ট্র। আজ মানব ইতিহাসে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এই
অভিযান শুরু এবং নেতৃত্ব দিয়েছে। আজ সেই দিন যা নাসার শক্তি এবং বাণিজ্যিক অংশীদারত্বের প্রমাণ দেয়।'
বিবিসি জানিয়েছে, ওডির চন্দ্রাভিযানের শুরুটা প্রায় নিরবচ্ছিন্ন হলেও এক পর্যায়ে কিছু কারিগরি সমস্যা তৈরি হওয়ায় অভিযান থামিয়ে দেওয়ার শঙ্কাও দেখা দিয়েছিল।
'ওডিসিয়াসের' উচ্চতা এবং গতিবেগ নিয়ন্ত্রণের রেজারগুলো ঠিকমতো কাজ করছিল না। তবে সৌভাগ্যবশত নাসার কিছু পরীক্ষামূলক লেজার থাকায় ইনটিউটিভের প্রকৌশলীরা সেগুলোকে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।
প্রথম দিকে রোবটটি থেকে কোনো সংকেত পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন নিয়ন্ত্রণকক্ষের প্রচন্ড স্নায়ুচাপে পড়েন। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই ক্ষীণ একটি সংকেত মেলে। আর কয়েক ঘণ্টা পর থেকেই 'ওডিসিয়াস' ছবি এবং তথ্য পাঠাতে শুরু করে।
রোবটটি চাঁদের সর্বদক্ষিণের বিন্দুতে স্থাপন করা হয়েছে। পাঁচ কিলোমিটার উচ্চতার পাহাড়ি এলাকার পাশে খানাখন্দে ভরা জায়গাটি 'ম্যালাপার্ট' নামে পরিচিত। 'ওডিসিয়াসের' আগে আর কোনো মহাকাশযান জায়গাটিতে পৌঁছায়নি।
চলতি দশকের শেষ দিকে নাসা 'আর্তেমিস' কর্মসূচির আওতায় চাঁদের যেসব জায়গায় মহাকাশচারী পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে তার সংক্ষিপ্ত তালিকায়ও রয়েছে এই স্থানটি।
চাঁদের এই স্থানটি এমন কিছু গভীর গর্ত রয়েছে যেগুলোতে কখনই সূর্যের আলো পৌঁছায়নি। গর্তগুলো একেবারেই ছায়ায় ঢাকা। এসব গর্তে জমাট বরফ থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন বিজ্ঞানীরা।
নাসার পস্ন্যানেটারি সায়েন্সের পরিচালক লরি গেস্নজ বলেন, 'বরফ গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমরা যদি চাঁদের উপরিভাগে পাওয়া বরফের সুবিধাকে কাজে লাগাতে পারি তাহলে আমাদের অনেক কম জিনিস (চাঁদে) আনতে হবে। আমরা এই বরফকে পানিতে- খাওয়ার উপযোগ্য পানিতে রূপান্তর করতে পারি, মহাকাশচারীদের স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অক্সিজেন এবং জ্বালানির জন্য হাইড্রোজেন তৈরি করতে পারব। তাই এটি (বরফ) মানুষের অভিযানে অনেক সহায়ক হবে।'
এদিকে, 'ওডিসিয়াসে' নাসা ছয়টি প্রযুক্তিগত এবং বৈজ্ঞানিক যন্ত্র স্থাপন করেছে। নাসা মূলত চাঁদের ধূলিকণার আচরণগত বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করবে। অ্যাপোলোর মহাকাশচারীরা ধুলার কারণে বেশ ভোগান্তিতে পড়েছিলেন। তাদের যন্ত্রপাতিতে ধুলার আঁচড় লাগার পাশাপাশি সেগুলো আটকে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছিল।
এছাড়াও এমব্রি-রিডল অ্যরোনটিক্যাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের একটি ক্যামেরা সিস্টেমও 'ওডিসিয়াসে' রয়েছে। ক্যামেরা সেটটি মূলত সেলফি তোলার জন্য রাখা হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পী জেফ কুনসও রোবটিতে একটি বাক্স জুড়ে দিয়েছেন যেটিতে রয়েছে স্টিলের ১২৫টি বল। এক মাস ধরে চাঁদের যে রূপ বদল হবে সেটি বোঝাতেই তিনি বলগুলো দিয়েছেন।