মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই হবে চ্যালেঞ্জ

এক মাসের ব্যবধানে দুই দফায় বাড়ছে বিদু্যতের দাম!

প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

রেজা মাহমুদ
আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে মার্চেই দেশের বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম নির্ধারণ করা হবে। এতে জ্বালানি তেলের পাশাপাশি বাড়বে বিদু্যতের দামও। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী মাসের শুরুতেই খুচরা পর্যায়ে ৪ শতাংশ এবং ঈদের পরে এপ্রিলে আরও ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিদু্যতের দাম বাড়নোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। সে হিসাবে মাত্র এক মাসের ব্যবধানে বিদু্যতের দাম দুই দফায় বাড়তে পারে। বাংলাদেশে বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিরি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। অন্যদিকে মার্চে জ্বালানি তেলের দামও স্বংয়ক্রিয় পদ্ধতিতে খুচরা পর্যায়ে দাম সমন্বয় করা হবে। পেট্রোবাংলার তথ্যমতে, বর্তমান আমদানি মূল্যে বিবেচনায় খুচরায় পেট্রোল, অকটেন ও ডিজেলের লিটারে দুই দফায় বাড়তে পাবে। এদিকে জ্বালানি পণ্য ও বিদু্যতের দাম বৃদ্ধিতে খাদ্যসহ সব ধরনের পণ্যের উৎপাদন ব্যয় আরও বাড়বে, এতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা চ্যালেঞ্জিং হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, তেল বিক্রি করে সরকার যে পরিমাণ মুনাফা করেছে তার থেকে লোকসান অনেক কম। তাই তেলের দাম এ মুহূর্তে বাড়ানো উচিত নয়। কারণ এতে খাদ্য উৎপাদন \হব্যয় বাড়িয়ে দেবে। অন্যদিকে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় কমিয়ে আনলেই বিদু্যৎ খাতে ভর্তুকি কমানো সম্ভব। শুধু গ্রাহকের উপর বিলের চাপ বাড়ানো একমাত্র উপায় নয় বলেও মনে করেন তারা। চলতি বছরের শুরুতেই বিদু্যৎসহ দেশের বাজারে জ্বালানি পণ্যের দাম সমন্বয়ের কথা জানিয়েছিল জ্বালানি বিভাগ। কিন্তু নির্বাচনের পরে সার্বিক মূল্যস্ফিতি বেড়ে যাওয়ায় তা মার্চ পর্যন্ত পেছানো হয়। এর আগে গত বছরের শুরুতে মার্চ পর্যন্ত তিন দফায় বিদু্যতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। পরবর্তিতে নির্বাচনের কারণে রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রতিমাসে দাম সমন্বয় থেকে সরে আসে সরকার। এমনকি আইএমএফএর ঋণের শর্ত থাকা সত্ত্বেও দাম বাড়ানো হয়নি। তবে এবার মার্চের শুরুতেই জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের পাশাপাশি বিদু্যতের উৎপাদন ব্যয় হিসাব করে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে নতুন দাম নির্ধারণ করা হবে। এছাড়াও বিদু্যৎ খাতে বিদ্যমান ভর্তুকি ধাপে ধাপে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে, বাংলাদেশ বিদু্যৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্যানুযায়ী, মার্চের শুরুতেই খুচরা পর্যায়ে বিদু্যতের দাম ৪ শতাংশ বাড়ানো হতে পারে। এছাড়াও ঈদের পর আরও এক দফায় ৪ থেকে ৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। বিপিডিবি'র সূত্র জানিয়েছে, জ্বালানি বিভাগ বিদু্যৎ খাতে ধাপে ধাপে দাম সমন্বয়ের মাধ্যমে আগমী ২ বছরের মধ্যে ভর্তুকি তুলে নিতে চায়। সে ক্ষেত্রে খুচরায় বিদু্যতের দাম বাড়াতে হবে প্রায় ৮০ শতাংশ। বর্তমানে পাইকারি পর্যায়ে বিদু্যতের প্রতি ইউনিটের দাম ৬.৭০ টাকা রয়েছে। তবে ভর্তুকি তুলে নিলে এর দাম দাঁড়াবে ১২.১১ টাকা। একইভাবে বর্তমানে খুচরায় প্রতি ইউনিট বিদু্যতের দাম রয়েছে ৮.২৪ টাকা, ভর্তুকি তুলে নিলে এর দাম দাঁড়াবে প্রায় ১৫ টাকা। এ বিষয়ে বিদু্যৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানিয়েছেন, রমজান ও ঈদের পর ৪ থেকে ৫ শতাংশ হারে বিদু্যতের দাম বাড়ানো হবে এবং আগামী দুই বছরের মধ্যে এখাতে ভর্তুকি তুলে নেওয়া হবে। যেহেতু ধাপে ধাপে দাম বাড়ানো হবে তাই গ্রাহকের উপর বাড়তি চাপ পড়বে না। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্ত অনুযায়ী ২০২৩ সালের শুরুতেই আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারে জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ের কথা ছিল। তবে গত ১৪ মাসেও তা কার্যকর হয়নি। এমনকি গত বছর জুনে আইএমএফ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে সেপ্টেম্বরে তা কার্যকরের কথা জানানো হলেও নির্বাচনের কারণে তা এ বছর মার্চ পর্যন্ত পেছানো হয়। দেখা গেছে গত বছরের প্রথম ৭ মাস জ্বালানি তেলে সরকার ব্যাপক মুনাফা করলেও বর্তমানে আমদানি মূল্য বাড়তির দিকে রয়েছে। ফলে এই মুহূর্তে দাম সমন্বয় করা হলে দেশের বাজারে তেলের দাম আবারও বাড়বে। সে হিসাবে প্রতি লিটার ডিজেল ১০ টাকা এবং পেট্রোল-অকটেনে ১৫ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে। যদিও গত বছরে প্রথম সাত মাসে প্রতি লিটার ডিজেলে ২৯ টাকা পর্যন্ত মুনাফা করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন। তবে আগস্টের শুরু থেকে বিশ্ববাজারে ধারাবাহিকভাবে পরিশোধিত ও অপরিশোধিত দুই ধরনের তেলের দাম বাড়তে থাকায় ভর্তুকি দিতে হয়েছে সংস্থাটিকে। এর আগে গত আগস্টে চলতি ২০২৩ সালের মধ্যে সর্বোচ্চ অবস্থায় পৌঁছায় অপরিশোধিত তেলের আমদানি মূল্য। তখন ৭৪ ডলার থেকে বেড়ে আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের ব্যারেল দাম দাঁড়ায় প্রায় ৯০ ডলারে। ফলে দেশের বাজারে লোকসানে তেল বিক্রি করতে হয় বিপিসিকে। তবে এ বছরের শুরু থেকেই নিম্নমুখী জ্বালানি তেলের বাজার। বৃহস্পতিবারের তথ্যানুযায়ী, এদিন ব্যারেল ক্রুড অয়েল বিক্রি হয়েছে ৮১ ডলারে। সে হিসাবে জ্বালানি তেলের বাজার এখনো অস্থিতিশীল। অন্যদিকে দাম বাড়ানো পরেও নিরবচ্ছিন্ন বিদু্যৎ নিয়েও শঙ্কা রয়েছে সংশ্লিষ্ট মহলে। অর্থনীতিবিদ ডক্টর জাহিদ হোসেন যায়যায়দিনকে বলেন, এই মুহূর্তে দেশের অর্থনীতি পুনঃরুদ্ধারে সুলভ মূল্যে জ্বালানি কিংবা বিদু্যতের নিশ্চয়তা দারকার। উল্টো যদি এর দাম বাড়ানো হয় স্বাভাবিক ভাবেই মূল্যস্ফীতি নিন্ত্রয়ণ কঠিন হয়ে পড়বে। দেশের মানুষের বড় একটি অংশই এই বর্ধিত জ্বালানি ব্যয় ও পরোক্ষভাবে জীবন-যাপনের বাড়তি ব্যয় মেটাতে পারবে না। সরকার কেন শুধু গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি তুলে নিতে চায়, তারা চাইলে গ্রাহক পর্যায়ে দাম না বাড়িয়ে ভর্তুকি কমাতে পারেন বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, বিদু্যৎ খাতে সরকারের যে ব্যয় তার বড় একটি অংশই ক্যাপাসিটি চার্জ। বছরের পর বছর বিদু্যৎ উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। সরকারের উচিত শুধু গ্রাহকের উপর বিলের চাপ না বাড়িয়ে বিদু্যৎ উৎপাদনকারীদের সঙ্গে নতুন চুক্তি করা এবং পুরানো চুক্তি বাতিল করা। তা করা হলে জনগণ আরও কম মূল্যে বিদু্যৎ পাবে বলে মনে করেন তিনি। \হ