সমুদ্রে বিপণ্ন প্রজাতির প্রাণী কচ্ছপের মৃতু্যর মিছিল দীর্ঘতর হচ্ছে। সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের উদ্যোগ ও বিপণ্ন কচ্ছপ রক্ষা এখন খুবই জরুরি হয়ে উঠেছে। সমুদ্র উপকূলের এই সময়টা প্রজনন সময় কচ্ছপ দল বেঁধে হাজারও মাইল পাড়ি দিয়ে বালিয়াড়িতে ডিম পাড়তে আসে। কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে বিভিন্ন পয়েন্টে সামুদ্রিক ডিমওয়ালা কচ্ছপ মারা যাওয়ায় উদ্বিগ্ন সমুদ্র বিজ্ঞানীরা।
কয়েক দশক ধরে এদের প্রজনন ক্ষেত্র অরক্ষিত হওয়ায় প্রতিবছর সৈকতে ডিম পাড়তে এসে মারা পড়ছে স্ত্রী কচ্ছপ। কক্সবাজারে পর্যটনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নে সৈকতে আলোকায়ন, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়া, ডিম ছাড়ার মৌসুমে বিচে ডাইভিং, খেলাধুলা, সৈকতে হাঁটা কচ্ছপের ডিম দেওয়ার পরিবেশ সংকটাপণ্ন হয়ে উঠেছে। চলতি প্রজনন মৌসুমে এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাধিক ডিমওয়ালা কচ্ছপ মারা গেছে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মা কচ্ছপ সাগর পাড়ে ডিম ছাড়তে আসা-যাওয়ার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। এই সামুদ্রিক কচ্ছপকে রক্ষা করতে
হলে সৈকত এলাকায় তাদের আবাসস্থল যেন ধ্বংস না হয়, সেই জন্য আলোকায়ন অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে। এ ছাড়া সৈকতে পুঁতে রাখা মাছ ধরার অবৈধ কারেন্ট জাল ব্যবহারও বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে সৈকতে এসে মা কচ্ছপ ডিম পাড়তে পারলেও সেই ডিম রক্ষা করা যাচ্ছে না। ডিমগুলো খেয়ে ফেলছে কুকুর বা অন্যকোন প্রাণী। ফলে কূল এখন মা কচ্ছপের ডিম ছাড়ার জন্য তাদের আবাসস্থল অরক্ষিত হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট (বোরির) দেওয়া তথ্য মতে, জানুয়ারি থেকে মঙ্গলবার ২০ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলের সোনাদিয়া, পেঁচার দ্বীপ, হিমছড়ি, সোনারপাড়া, ইনানী ও টেকনাফ, সেন্ট মার্টিন সৈকতে অন্তত অর্ধশতাধিকের কাছাকাছি বড় আকৃতির মৃত কচ্ছপের সন্ধান মিলেছে। সামুদ্রিক মা কচ্ছপের ডিম দেওয়ার সময় নভেম্বর মাস থেকে শুরু হয়ে এপ্রিল-মে পর্যন্ত। সমুদ্র উপকূলের ৩৪ পয়েন্টের মহেশখালীর সোনাদিয়া থেকে শুরু করে সেন্টমার্টিন দ্বীপ পর্যন্ত তারা রাতের বেলায় নির্জন স্থানে এসে একটি গর্ত তৈরি করে ডিম দেয়। একটি মা কচ্ছপ ৬০-১০০টি পর্যন্ত অনেক সময় তার চেয়ে বেশি ডিম দিয়ে থাকে। ডিম দেওয়া শেষ করে মাটিচাপা দিয়ে মা কচ্ছপ ফিরে যায় সাগরে। এ সময় প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে ৬০-৭০ দিনের মধ্যে ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে গর্ত থেকে বের হয়ে সাগরে চলে যায়।
জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম হচ্ছে নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। গত ১৫ দিনে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের হিমছড়ি, সোনারপাড়া ও ইনানীর প্রায় ১০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত পর্যবেক্ষণ করে ১৭টি অলিভ কচ্ছপের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সব কটির পেটে ডিম ছিল। গত জানুয়ারি থেকে ২০ ফেব্রম্নয়ারি পর্যন্ত ৩৬টি অলিভ রিডলি কচ্ছপ মারা পড়েছে। তবে চলতি প্রজনন মৌসুমে ৭৮ অলিভ রিডলি ডিম পেড়েছে ৯ হাজার ২৯২টি। সেগুলো প্রাকৃতিক হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে সাগরে ভেসে আসা মৃত সামুদ্রিক প্রাণীগুলোর নমুনা সংগ্রহ করে মৃতু্যর কারণ অনুসন্ধানে কাজ করছে সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিন বিভিন্ন তথ্যে জানা গেছে, একমাত্র সামুদ্রিক কচ্ছপ যাদের ফ্লিপার আছে, যেগুলো বড় এবং ডিম পাড়ার জন্য নরম বালিতে আসে। সবুজ কচ্ছপ দীর্ঘজীবী এবং কমপক্ষে ৭০ বছর বা এরও বেশি সময় বেঁচে থাকতে পারে। স্ত্রী সবুজ কচ্ছপ ২৫-৩৫ বছর বয়সে পরিপক্ক হয়। সামুদ্রিক কচ্ছপের ডিমগুলো পিং পং বলের মতো গোলাকার। এসব ডিমের শক্ত বাহ্যিক অংশের পরিবর্তে নরম। এরা ডিম পাড়ার সময় সমুদ্র উপকূলের খুব নির্জন স্থানে বেছে নেয়। যদি কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি দেখে, তাহলে ডিম পাড়া বন্ধ করে মা কচ্ছপ পুনরায় সমুদ্রে ফিরে যায়। কচ্ছপ শুকনো বালু সরিয়ে ৫০-৬০ সে.মি. বা ১০০-১১০ সে.মি. গর্ত করে ১০০-১৫০টি গোলাকার সাদা নরম ডিম দেয়। সামুদ্রিক কচ্ছপ ডিম ছাড়ার পর প্রায় ৬০ দিন ধরে উষ্ণ বালিতে প্রাকৃতিক নিয়মে ডিম ফুটে বের হয়ে সমুদ্রে চলে যায়। এরা মূলত বালির তাপমাত্রা বাচ্চা সামুদ্রিক কচ্ছপের লিঙ্গ নির্ধারণ করে, শীতল বালি বেশি পুরুষ ও উষ্ণ বালিতে মেয়ে হয়। বাচ্চা কচ্ছপগুলো যে সমুদ্রের উপকূলে জন্মেছিল বয়ঃপ্রাপ্তির পর সে বালিয়াড়িতেই তারা আবার ডিম দিতে আসে। খাদ্য তালিকায় কাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক, জেলিফিশ, সাগর শসা, চিংড়ি, লবস্টার, শেওলা ও সামুদ্রিক ঘাস খেয়ে থাকে। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত রিডলি প্রজাতির সামুদ্রিক কচ্ছপের প্রজনন মৌসুম। এ সময় এরা দলে দলে সৈকতের বালিয়াড়িতে ডিম পাড়তে আসে। পথে জেলেদের জালে আটকা পড়ে বা অন্য কোনোভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে মা কচ্ছপ মারা পড়ছে।
গত ২০ ফেব্রম্নয়ারি সমুদ্র উপকূলে পাঁচটি কচ্ছপই অলিভ রিডলি কচ্ছপ মৃত পাওয়া গেছে। এ নিয়ে গত ১০ দিন কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের হিমছড়ি, পেঁচার দ্বীপ, সোনারপাড়া ও ইনানীর প্রায় ১০ কিলোমিটার উপকূল অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করে ১৭টি অলিভ মা কচ্ছপের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। সব কটির পেটে ডিম ছিল। যে মৃত কচ্ছপে পাওয়া গেছে ৭০০ ডিম। চলতি প্রজনন মৌসুমে ৭৮ অলিভ রিডলি কচ্ছপ ডিম পেড়েছে ৯ হাজার ২৯২টি। সেগুলো প্রাকৃতিক হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. তৌহিদা রশীদ বলেন, সমুদ্র উপকূলে দুই প্রজাতির কচ্ছপের মধ্যে অলিভ রিডলি প্রজাতির আধিক্য অনেক বেশি। এরা সাইজেও কিছুটা ছোট হলেও ৬০-৭০ সেমি লম্বা এবং ৩০-৩৫ কেজি ওজনের হয়ে থাকে। এই প্রজাতির মা কচ্ছপগুলো দলবেঁধে কুলে এসে ডিম ছাড়ে।
তিনি আরও বলেন, ডিম পাড়ার পর পুনরায় গভীর সাগরে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ এখন যেন আর নেই। সমুদ্র উপকূলে পাওয়া মৃত কচ্ছপগুলোর শীরের দেখা গেছে আঘাতের চিহ্ন। তাদের শরীরে গায়ের কোনো অংশ রক্তাক্ত আবার কোনো অংশ ছিন্ন ভিন্ন। রাতের আঁধারে ডিম দিতে এসে অনেক সময় কুকুর শিয়ালের আক্রমণের শিকার হয়ে এসব কচ্ছপ মারা যায়। গত কয়েক দিন ধরে ভেসে আসা মৃত কচ্ছপগুলোর নমুনা সংগ্রহ করে মৃতু্যর কারণ অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টরা কাজ করছেন। বিষয়টি খুব গুরুত্বসহকারে দেখা হচ্ছে বলে জানান তিনি।