একমাত্র সন্তান রাতুলকে নিয়ে ব্যাংক কর্মকর্তা জামিলা খাতুন থাকেন ঢাকার রামপুরা মহানগর প্রকল্পে। ছেলের বয়স ১০ পেরিয়ে যাওয়ায় দ্রম্নত তার খতনা করানো নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। প্রবাসী স্বামী জানুয়ারির প্রথমভাগে দেশে ফিরে উদ্যোগ নিলেও স্কুলে নতুন ক্লাস শুরু হওয়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি। এ অবস্থায় রমজানের ছুটিতে খাতনা করানোর বিষয়টি চূড়ান্ত করেছিলেন তারা। কোন হাসপাতালে কবে কোন চিকিৎসককে দিয়ে খতনা করাবেন তা-ও ঠিকঠাক।
তবে মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে খতনা করাতে গিয়ে ঢাকায় দুই শিশুর মৃতু্য এবং নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জে অতিরিক্ত চামড়া কেটে ফেলায় মারাত্মক রক্তক্ষরণের ঘটনায় তারা এখন ভীষণভাবে আতঙ্কিত। খতনা করার কথা মনে করে রাতুল ঘুমের মধ্যে আঁতকে উঠছে বলে জানান তার মা।
একই অবস্থা মাতুয়াইলের বাসিন্দা প্রকৌশলী সাইদুর রহমানেরও। দু'দিন আগে রংপুরের কর্মস্থল থেকে এক সপ্তাহের ছুটি নিয়ে গত রোববার তিনি ঢাকায় এসেছেন ৭ বছরের ছেলে সায়মনের খতনা করানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু ২০ ফেব্রম্নয়ারি দিবাগত রাতে মালিবাগের জেএস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল চেকআপ সেন্টারে খতনা করাতে গিয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের শিক্ষার্থী দশ বছর বয়সি আহনাফ তাহমিন আয়হামের মৃতু্যর ঘটনায় তার পুরো পরিবার এখন আতঙ্কিত। খতনা করার কথা ভেবে ভয়ে শিউরে উঠছে সায়মনের বাবা-মাও।
শুধু রাতুল-সায়মন বা এদের এই দুই পরিবারই নয়, খতনা নিয়ে উদ্বেগ আতঙ্কে রয়েছে সারা দেশের লাখ লাখ অভিভাবক ও শিশু। আগের মতো হাজাম দিয়ে নাকি অত্যাধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জামাদি দিয়ে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক দিয়ে খতনা করানো উচিত তা নিয়ে নতুন করে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়েছেন অনেকেই। কাকে দিয়ে কখন কীভাবে খতনা করালে সন্তানের জীবন ঝুঁকি বা অন্য কোনো শারীরিক সমস্যায় পড়বে না- তা নানাভাবে খোঁজ-খবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা ভাবছেন সবাই।
এদিকে খতনা করাতে গিয়ে দুই শিশুর মৃতু্যর পর দুটি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানেরই লাইসেন্স এবং চিকিৎসকদের অ্যানেসথেসিয়া করানোর নিবন্ধন না থাকার বিষয়টি প্রকাশ পাওয়ার পর দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিভাবকরা অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, হাসপাতাল-ক্লিনিকে কোথায় কীভাবে কারা খতনা করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তা সঠিকভাবে নজরদারি করছে না। এ সুযোগে আনাড়ি চিকিৎসকরা যেনতেনভাবে
শিশুদের খতনা করছে। এতে মৃতু্যঝুঁকি ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে। অথচ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন এ ব্যাপারে নির্বিকার রয়েছে।
ঢাকার যেসব হাসপাতাল-ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শিশুর খতনা করানো হয়, ওইসব চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ৭ জানুয়ারি রাজধানীর বাড্ডায় ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খতনা করাতে গিয়ে ৫ বছরের শিশু আয়ান আহমেদের মৃতু্যর পর হঠাৎ করেই খতনা করানো প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। যা ফেব্রম্নয়ারির মাঝামাঝিতে এসে ধীরে ধীরে কিছুটা বাড়ছিল। কিন্তু মালিবাগের জে এস ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড মেডিকেল সেন্টারে আহনাফ তাহমিন আয়হামের মৃতু্যর পর খতনা করানো যেন অনেকটাই বন্ধ হওয়ার পথে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ অবস্থা শুধু ঢাকাতেই নয়, সারাদেশেই খতনা কার্যক্রমে বড় ধরনের ধস নেমেছে। আসন্ন রমজানে স্কুল-মাদ্রাসায় ছুটি দেওয়া হলে যারা শিশু সন্তানদের খতনা করার পরিকল্পনা করেছিলেন তারা অনেকেই এখন এ সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন কিনা- তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন। যদিও চিকিৎসকরা বলছেন, শিশু আয়ান ও আয়হামের মৃতু্য একেবারেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। খতনা করাতে গিয়ে মৃতু্য কিংবা শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি নেই। তবে খতনা করানোর আগে বেশকিছু বিষয় জানা জরুরি। খতনা করার আগে ও পরে কিছু বিষয়ে সতর্কতা মেনে চললে এই প্রক্রিয়া শতভাগ নিরাপদ বলেই মনে করেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
চিকিৎসকরা জানান, সাধারণত তিন থেকে পাঁচ বছর বয়স খতনা করানোর জন্য আদর্শ সময়। তবে অন্য কোনো সমস্যা থাকলে কখনো কখনো এর আগেও খতনা করার প্রয়োজন হতে পারে। খতনা নিয়ে শিশুদের মনে অনেক ভয় কাজ করে। মা-বাবাকেই এই ভয় দূর করাতে হবে।
আগে থেকেই শিশুকে তৈরি করতে হবে, যাতে খতনা নিয়ে অহেতুক কোনো ভয় শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে।
খতনার জন্য জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার আগে অবশ্যই ঝুঁকিগুলো জেনে নিতে হবে। অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার জন্য শিশুর প্রি-অ্যানেসথেটিক চেকআপ হলো কি না দেখতে হবে। রোগীর জন্মগত হার্ট, ফুসফুস, লিভারের সমস্যা থাকলেও পুরো অজ্ঞান করাটা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই যার অপারেশন লাগবে তার জন্য জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া একমাত্র উপায় নাকি কোনো বিকল্প আছে তা পর্যালোচনা করা জরুরি।
এছাড়া মন চাইলেই শিশুকে নিয়ে হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারে ঢুকিয়ে না দিয়ে শিশুর খতনা করানোর আগে চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলতে হবে। খতনা-পূর্ব কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা বা পরামর্শ আছে কিনা তা জানা জরুরি। এছাড়া যে হাসপাতাল-ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে শিশুর খতনা করানো হবে সে চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা মান এবং যে চিকিৎসক এ কাজ করবেন তার সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নিতে হবে। খতনার সময় তিনিই অস্ত্রোপচার করছে কিনা, নাকি হাতুড়ে অন্য কাউকে দিয়ে করাচ্ছেন তা অভিভাবকদের স্বশরীরের উপস্থিত থেকে খোঁজ নেওয়া উচিত।
এদিকে হাজাম বা হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে খতনা করানো থেকে অভিভাবকদের সরে আসার পরামর্শ দেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্য, এখনো গ্রামে হাজাম বা হাতুড়ে ডাক্তার দিয়ে খতনা করার প্রচলনই বেশি। অথচ খতনা-পরবর্তী কোনো জটিলতা তৈরি হলে তা মোকাবিলা করার মতো দক্ষতা বা সুবিধা তাদের থাকে না। যদিও অনেক ক্ষেত্রেই এসব ঘটনা প্রকাশ পায় না। হাসপাতালে অভিজ্ঞ চিকিৎসক দিয়ে সার্জারি করানো হলে এ আশঙ্কা নেই বললেই চলে। কেননা তারা শিশুকে অ্যানেসথেসিয়া দেওয়ার বিষয়টি আগেভাগেই গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করেন।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাজী শহীদ-উল আলম বলেন, একজন রোগীকে পুরো অজ্ঞান করা সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। শতকরা হিসাবে সেটা ভগ্নাংশে হলেও যার জন্য ঘটে তার জন্য এটা শতভাগ। তাই কোনো রোগীকে অজ্ঞান করে অপারেশন করার আগে তার ফিটনেস যাচাই, ঝুঁকি পরিমাপ করা এবং রোগী কিংবা তার পরিবারের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করা প্রয়োজন। খতনা করানোর সময়ও জেনারেল অ্যানেসথেসিয়াই বেশি ব্যবহার করা হয়। একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক অবশ্যই এ বিষয়টি বিষদভাবে খতিয়ে দেখেন।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে কিছু ডিভাইস, এমনকি লেজারের মাধ্যমেও খতনার সার্জারি হচ্ছে। তবে ডিভাইস ব্যবহার করা হলে ব্যবহারকারী চিকিৎসক প্রশিক্ষিত কি না, সেটা জেনে নেওয়া জরুরি। লোকাল অ্যানেসথেসিয়া বা জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে এই অস্ত্রোপচার করা যেতে পারে। জেনারেল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার করতে হলে অবশ্যই শিশুকে ৬ ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হবে। দেশে পর্যাপ্ত অবেদনবিদ ও এনআইসিইউ সুবিধা না থাকায় অনেক সময় শিশুমৃতু্যর ঘটনাও ঘটে। তাই সন্তানের অস্ত্রোপচারের আগে কোন ধরনের অ্যানেসথেসিয়া ব্যবহার করা হবে, জেনে রাখা জরুরি।
অন্যদিকে খতনার অস্ত্রোপচার-পরবর্তী জটিলতা এড়াতে বেশকিছু বিষয়ে জানা থাকা জরুরি বলে মনে করেন অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা। তারা জানান, খতনার অস্ত্রোপচারে সবচেয়ে বেশি যে জটিলতা দেখা যায়, তা হলো, রক্তপাতজনিত সমস্যা। অনেক সময় বাড়ি নিয়ে আসার পর আবার রক্তপাত শুরু হতে পারে। বেশি রক্তপাত হলে প্রথমে কাপড় দিয়ে চেপে ধরে রাখতে হবে। এরপরও না কমলে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। এছাড়া খতনার পরে লিঙ্গে ইনফেকশন ও লিঙ্গের অগ্রভাগে ক্ষত হতে পারে। সঠিক ওষুধ ও নিয়মিত ড্রেসিংয়ে এগুলো সহজেই সেরে যায়। লোকাল অ্যানেসথেসিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার করা হলে অনেক সময় লিঙ্গের গোড়া তিন-চার দিন ফোলা থাকতে পারে। এতে ভয়ের কিছু নেই।
এ ছাড়া অস্ত্রোপচারের পরের এক সপ্তাহে ক্ষতস্থান থেকে অল্প রক্তমিশ্রিত পানির মতো তরল আসতে পারে। এটিও এমনিতেই সেরে যাবে। নিয়মিত কুসুম গরম পানিতে গোসল করলে ক্ষতস্থান দ্রম্নত সেরে ওঠে। অস্ত্রোপচার-পরবর্তী সময় লুঙ্গি বা নরম ঢিলে কাপড় পরলে ব্যথা কম হয়। এক সপ্তাহের মধ্যেই ক্ষত সেরে গেলে স্বাভাবিক পোশাক পরে সব কাজ করা সম্ভব।
জনস্বাস্থ্যবিদরা জানান, সাধারণত ধর্মীয় রীতি অনুসারে মুসলিম ছেলে শিশুদের খতনা করা হলেও কিছু কিছু জন্মগত রোগেও এটি করার নির্দেশনা আছে। এগুলোর মধ্যে যাদের লিঙ্গের অগ্রভাগের ছিদ্র ছোট থাকে, বারবার তাদের প্রস্রাবে সংক্রমণ হতে পারে। যাদের চামড়া গস্নান্স লিঙ্গের পেছনে আটকে গিয়ে ব্যথা করে, তাদের ক্ষেত্রে এটি করা হয়। এই দুটি অবস্থার মেডিকেল টার্ম হলো ফাইমোসিস আর প্যারাফাইমোসিস।
আবার কারও কারও জন্য খতনা করা নিষেধ। যেমন- যাদের হিমোফিলিয়া নামের রক্তরোগ আছে, তাদের খতনা করতে বারণ করা হয়। কারণ কাটাছেঁড়া করা হলে তাদের রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না। যাদের প্রস্রাবের নালির ছিদ্র ভিন্ন জায়গায় থাকে। এসব রোগীদের নালি ঠিক করার অস্ত্রোপচারের সময় লিঙ্গের অগ্রভাগের চামড়া নতুন নালি তৈরিতে কাজে লাগে।