এক সপ্তাহে ৩টি ডলফিনের মৃতু্য

সমুদ্রে বিপন্ন ইরাবতী ডলফিন

প্রকাশ | ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

আলতাব হোসেন
সমুদ্রে বিপন্ন প্রজাতির প্রাণীর মৃতু্য বাড়ছে। কক্সবাজার সমুদ্র উপকূল ও কুয়াকাটা সৈকতে একের পর এক ভেসে আসছে বিরল প্রজাতির ইরাবতী ডলফিন। মাত্র এক সপ্তাহে উপকূলে মিলেছে ৩টি মৃত ইরাবতী। উপকূলীয় অঞ্চলে সুরু জাল এবং বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরার কারণে ঝুঁকিতে পড়েছে ইরাবতী ডলফিন। একের পর এক বিপন্ন ইরাবতী ডলফিনের মৃতু্য ঘটনায় উদ্বিগ্ন সমুদ্র বিজ্ঞানীরা। বুধবার পটুয়াখালীর কুয়াকাটা সৈকতে ৫ ফুট লম্বা একটি ইরাবতী ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে আসে। এর আগে ১৬ ফেব্রম্নয়ারি কক্সবাজারের উখিয়ার সোনারপাড়া সৈকতে একটি এবং ইনানী সৈকতে একটি মৃত ইরাবতী ডলফিন ভেসে আসে। বাংলাদেশে ইরাবতী ডলফিনের মৃতু্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি হচ্ছে বলছেন বিরল ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্য। ২০১৭ সাল থেকে সেভ দ্য নেচার অব বাংলাদেশ ৩০০টি ডলফিনের মৃতু্য লিপিবদ্ধ করেছে। পটুয়াখালী থেকে শুরু করে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত উপকূলজুড়ে বেশ কিছু প্রজাতির ডলফিনের মৃতদেহ ভেসে উঠেছে। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংস্থা (আইইউসিএন) ইরাবতী ডলফিনের প্রজাতিকে বিপন্ন ঘোষণা করেছে। গত ১০ বছরে প্রজাতিটির সংখ্যা ৫০ শতাংশ কমেছে। পরিবেশবিদ ড. ইমরাম উলস্নাহ সরদার বলেন, বিশ্বের ৮০ শতাংশ ইরাবতী ডলফিনের বাস বাংলাদেশে। বাংলাদেশে ইরাবতী ডলফিন সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সুন্দরবন ও গঙ্গা ব্রহ্মপুত্র-মেঘনার সম্মিলিত অববাহিকার একদম দক্ষিণে। বাংলাদেশ সরকার ডলফিন রক্ষায় ৯টি অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে। ডলফিন রক্ষায় এমন উদ্যোগ বিশ্বে প্রথম। ডলফিন অ্যাকশন পস্ন্যান এবং দেশের অভ্যন্তরে ডলফিনের বিস্তৃতি বিষয়ক অ্যাটলাস প্রস্তুত করা হয়েছে। হালদা নদীতে ডলফিনের সংখ্যা নির্ণয় এবং ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সুন্দরবনের ডলফিন অভয়ারণ্যের জন্য কমিউনিটিভিত্তিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এ বিষয়ে সুন্দরবন দক্ষিণের বন সংরক্ষক ইসমাইল হোসেন বলেন, বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনে ডলফিন হত্যার জন্য সর্বোচ্চ তিন বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ড এবং একই অপরাধের পুনরাবৃত্তি ঘটালে পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড অথবা সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ড বিধান অন্তর্ভুক্ত করা রয়েছে। সুন্দরবনের ডলফিন সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় ৭০ সদস্যের সাতটি ডলফিন কনজারভেশন দল গঠন করা হয়েছে এবং তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে ডলফিন সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। সুন্দরবনের ডলফিন অভয়ারণ্যসংলগ্ন মৎস্য সম্পদের ওপর নির্ভরশীল এক হাজার জনকে প্রশিক্ষণ প্রদান এবং বিকল্প আয় বৃদ্ধিমূলক আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। কুয়াকাটা ডলফিন রক্ষা কমিটির সদস্য জুয়েল রানা জানান, বুধবার (২১ ফেব্রম্নয়ারি) সকালে কুয়াকাটার জিরো পয়েন্ট থেকে ছয় কিলোমিটার পূর্বদিকে গঙ্গামতি এলাকায় ডলফিনটি দেখতে পান। এটি ইরাবতী ডলফিন। বনের ভিতরে বিষ দিয়ে মাছ ও বন্যপাণি শিকার করার কারণে গত বছর ১৫টি এবং ২০২২ সালে ১৯টি মৃত ও জীবিত ডলফিন ভেসে আসে। এ ছাড়াও প্রায়ই বনের মধ্য দিয়ে জ্বালানি তেলবাহী জাহাজ ডুবির কারণে বিরল প্রজাতির ইরাবতী ডলফিনের মৃতু্য হচ্ছে। বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক তৌহিদা রশীদ বলেন, গত ১৬ ফেব্রম্নয়ারি কক্সবাজারের রামু উপজেলার হিমছড়ি সমুদ্রসৈকতে জোয়ারের পানিতে ৬ ফুট দৈঘ্যের একটি মৃত ইরাবতী ডলফিন ভেসে আসে। কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের পাশে সৈকতের সোনারপাড়া এলাকায় জোয়ারের পানিতে একটি ইরাবতী ডলফিন ভেসে আসে। বাংলাদেশ ওশানোগ্রাফিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (বিওআরআই) সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সফিকুল ইসলাম জানান, ভেসে আসা মৃত ইরাবতী ডলফিনটি ইন্দো প্যাসিফিক হ্যাম্পব্যাক প্রজাতির। এর ওজন ২৪০ কেজি এবং দৈর্ঘ্য ৮ ফুট ১০ ইঞ্চি। ডলফিনটির কঙ্কাল ভবিষ্যতে শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রমে ব্যবহারে জন্য সংরক্ষণ করা হবে। সোনারপাড়ায় আসা মৃত ইরাবতী ডলফিনটির দৈর্ঘ্য ৪ ফুট ৭ ইঞ্চি এবং ওজন ৭০ কেজি। দুটির নমুনা সংগ্রহের পর সৈকতের বালিয়াড়িতে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এক থেকে দেড় বছর পর ডলফিন দুটির কঙ্কাল তুলে সংরক্ষণ করা হবে। অনুসন্ধানে জানা যায়, সরকার ১৯৯৬ সালে সুন্দরবনে তিনটি অভয়ারণ্য ও ২০১২ সালে তিনটি ডলফিন অভয়ারণ্য প্রতিষ্ঠা করে এবং ২০১৪ সালে সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডকে মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া হিসেবে ঘোষণা করে। সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডে রয়েছে তিমি, ডলফিন, হাঙরসহ বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণীর অভয়ারণ্য। সুন্দরবন থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত সাবমেরিন ক্যানিয়ন বা 'সোয়াচ অব নো-গ্রাউন্ড'কে বলা হয় ডলফিনের স্বর্গ। সোয়াচ অব নো-ল্যান্ড হলো সুন্দরবনসংলগ্ন বঙ্গপসাগরের মুখে গড়ে ওঠা ১৪ কিলোমিটার চওড়া এবং সমুদ্রের তলদেশ থেকে হাজার মিটারের বেশি গভীর এক প্রাকৃতিক খাত (ক্যানিয়ন), যার গভীরতা পরিবর্তনশীল। যে কেউ একে চিনতে সক্ষম কারণ এ এলাকার পানির রংয়ের আশপাশের পানির রং থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সুন্দরবনে তিন ধরনের ডলফিন ও এক প্রজাতির পাখনাবিহীন শুশুক পাওয়া যায়। সমুদ্র বিজ্ঞানী ড. সামসুল আলম বলেন, ইরাবতী ডলফিনের পিঠে ছোট ত্রিকোণ একটি পাখনা আছে। যার অগ্রভাগ প্রায় গোলাকৃতি ও ভোঁতা। এদের ঠোঁটহীন মাথাও ভোঁতা। সোজা মুখাবয়ব এবং ঘাড়ের কাছে ভাঁজ সদৃশ্যমান। পূর্ণবয়স্ক ইরাবতী ডলফিন আকারে দুই থেকে ২.৭৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। এদের পিঠ ও পাশের রং ধূসর ও নীলাভ-ধূসর এবং পেটের রং কিছুটা হালকা। এরা দলবদ্ধ প্রাণী। ইরাবতী ডলফিন গ্রীষ্মমন্ডলীয় ও উপ-গ্রীষ্মমন্ডলীয় ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের উপকূলীয় লবণ ও মিঠাপানিতে বাস করে। উত্তর অস্ট্রেলিয়া ও নিউগিনি থেকে বঙ্গোপসাগর এবং ইরাবতী নদী মেকং নদী, মহাকাম নদী, গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীতে ইরাবতী ডলফিন দেখতে পাওয়া যায়। তিনি আরও জানান, সুন্দরবনে রয়েছে বিপন্ন প্রায় আরেক প্রজাতির গোলাপি ডলফিন। এ গোলাপি ডলফিনকে কেউ বলে ডানাকাটা পরী, আবার কেউ বলে সাগরের রাজকন্যা। এক সময় হারহামেশায় দেখা মিললেও এখন বঙ্গোপসাগরে ও মোহনায় কালেভদ্রে এদের দেখা পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। ২০০২ সালেও ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির একটি জরিপে বাংলাদেশে গোলাপি ডলফিনের অস্তিত্ব পাওয়ার কথা জানায়। পৃথিবীজুড়ে গোলাপি ডলফিনকে বিপন্নপ্রায় প্রজাতি হিসেবে মনে করা হয়। ব্যতিক্রমী গায়ের রং ছাড়া এই ডলফিনের আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে এর আকৃতি ও ওজন। পৃথিবীতে যে আট প্রজাতির ডলফিন আছে, তার মধ্যে এটি সবচেয়ে বড় ও বিরল।