দুই শিশুর মৃতু্যকে ঘিরে 'অজানা ভাইরাস' আতঙ্ক

প্রকাশ | ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
মুফতাউল মাসিয়া ও মুনতাহা মারিশা
কুড়িয়ে আনা বরই খেয়ে অসুস্থ হয়ে দুই শিশুর মৃতু্য এবং পরে এর প্রকৃত কারণ না জানা যাওয়ায় 'অজানা ভাইরাস' আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে রাজশাহীর সাধারণ মানুষের মধ্যে। এদিকে মারা যাওয়া দুই শিশু এবং আইসোলেশনে থাকা তাদের মা-বাবার নিপাহ ভাইরাস, করোনা ও ডেঙ্গু টেস্ট রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এজন্য অজানা ভাইরাস নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছেন চিকিৎসকরাও। খেজুর রস এড়িয়ে চলাসহ ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, জ্বর, বমির পর সারা শরীর ভরে গিয়েছিল ছোপ ছোপ কালো দাগে। এমন উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে দুই বোন। চিকিৎসা দূরের কথা, রোগ শনাক্তের সময়ও পাননি চিকিৎসকরা। চিকিৎসকরা ধারণা করছেন, অজানা কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারেন তারা। মৃতু্যর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে ঢাকা থেকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম রাজশাহী যাচ্ছেন। মারা যাওয়া দুই শিশু মুনতাহা মারিশা (২) এবং মুফতাউল মাসিয়াকে (৫) পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়েছে। তাদের মা-বাবাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশনে রাখা হয়েছে। তাদের শরীরে নিপাহ ভাইরাসের উপস্থিতি আছে কিনা, তা শনাক্তে নমুনা পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। মৃত শিশুদের বাবার নাম মঞ্জুর হোসেন (৩৫) এবং মায়ের নাম পলি খাতুন (৩০)। তাদের বাড়ি রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়া গ্রামে। মঞ্জুর রাজশাহী ক্যাডেট কলেজের গণিত বিভাগের শিক্ষক। পরিবার নিয়ে তিনি ক্যাডেট কলেজের কোয়ার্টারে থাকেন। দুই শিশুকে তাদের গ্রামের বাড়ি দুর্গাপুর উপজেলার চুনিয়াপাড়ায় দাফন করা হয়েছে। গ্রামের বাড়িতে শিশুদের দাদি আঞ্জুয়ারা এবং হাসপাতালে শিশুদের মা পলির আহাজারি কিছুতেই থামছে না। হাসপাতালে মঞ্জুর-পলি দম্পতির পাশে আছেন তাদের স্বজন রইস উদ্দিন। তিনি বলেন, 'এ ঘটনার পর বাড়িতে মঞ্জুরের মা মুমুর্ষু হয়ে পড়েছেন। কিছুতেই তার আহাজারি থামছে না। সংজ্ঞা জ্ঞান হারিয়ে ফেলছেন। এদিকে হাসপাতালে শিশু দুটির মা পলি আহাজারি করছেন। তাকেও কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না।' রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ আবু হেনা মোস্তফা কামাল জানান, তিনি ওই দম্পতিকে দেখেছেন। তাদের জ্বর আসেনি। তারা নিজেরা বরই খাননি বলে জানিয়েছেন। তবে তারা দুটো বাচ্চাকেই কাছে রেখেছিলেন। শিশুদের মাধ্যমে মা-বাবার শরীরেও ভাইরাসের সংক্রমণ হতে পারে। এ আশঙ্কায় তাদের হাসপাতালে রাখা হয়েছে। পরীক্ষায় নিপাহ ভাইরাস শনাক্ত না হলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, মারা যাওয়া দুই শিশুকে গত বুধবার ১৪ ফেব্রম্নয়ারি গাছতলা থেকে বরই কুড়িয়ে এনে খেতে দিয়েছিলেন গৃহকর্মী। বরইগুলো ধোয়া ছিল না। পরদিন বৃহস্পতিবার ছোট মেয়ে এবং শনিবার বড় মেয়ের মৃতু্য হয়। চিকিৎসকদের আশঙ্কা, তারা নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল। মারা যাওয়া দুই শিশুর হঠাৎ জ্বর আর বমির লক্ষণ দেখা দেয়। মৃতু্যর আগে ও পরে দুজনেরই শরীরে ছোপ ছোপ কালোর্ যাশ দেখা দিয়েছিল। আর আইসোলেশনে থাকা শিশুদের মা-বাবার এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায়নি বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক। শিশুদের মা পলি খাতুন জানিয়েছেন, মঙ্গলবার (১৩ ফেব্রম্নয়ারি) সকালে কোয়ার্টারের গৃহকর্মী কলেজ ক্যাম্পাসের গাছ থেকে বরই কুড়িয়ে এনে দুই মেয়েকে খেতে দিয়েছিলেন। না ধুয়েই ওই বরই খেয়েছিল মারিশা আর মাসিয়া। সেদিন তারা ভালোই ছিল। পরদিন সকাল ১১টায় ছোট মেয়ে মারিশা জ্বরে আক্রান্ত হয়। বারবার পানি খাচ্ছিল। দুপুরের পর শুরু হয় বমি। তখন তারা মাইক্রোবাসে রাজশাহীর সিএমএইচ হাসপাতালে যাওয়ার পথে কাটাখালী এলাকায় মারা যায় মারিশা। শুক্রবার সকাল থেকে দুর্গাপুরের বাড়িতে মাসিয়ারও একই লক্ষণ দেখা দেয়। দ্রম্নতই তাকে প্রথমে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপেস্নক্স এবং পরে রাজশাহী সিএমএইচে নেওয়া হয়। রাতে মাশিয়ারও পুরো শরীরের্ যাশ দাগ উঠতে শুরু করে। তা দেখে সিএমএইচের চিকিৎসকরা রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন। রাত ৯টায় সেখান আনা হলে চিকিৎসকরা তাকে দ্রম্নত আইসিইউতে ভর্তি নেন। শনিবার বিকালে মাসিয়াও মারা যায়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজশাহীর একজন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক বলেন, 'দেশে নিপাহ ও ইনফ্লুয়েঞ্জাসহ মাত্র কয়েকটি ভাইরাস পরীক্ষার পদ্ধতি আছে। আর কোভিড-১৯-এর সময় করোনাভাইরাস পরীক্ষা শুরু হয়। অন্য কোনো ভাইরাস পরীক্ষার সক্ষমতাই নেই। এ অবস্থায় শিশু দুটি কোন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল তা আদৌ জানা যাবে কিনা তা নিয়েই অনিশ্চয়তা রয়েছে।' রামেক হাসপাতালের আইসিইউ ইনচার্জ সহযোগী অধ্যাপক ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, 'আমরা নিপাহ ভাইরাস আর মিশেরিয়া ব্যাকটেরিয়ার আশঙ্কা করেছিলাম। পরীক্ষায় এ দুটো রিপোর্টই নেগেটিভ এসেছে। আমরা আশঙ্কা করছি, কুড়িয়ে আনা বরই না ধোয়া অবস্থায় খেয়েই অজানা কোনো ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল শিশু দুটি। এভাবে জ্বর, বমির পরর্ যাশ উঠে দ্রম্নতই রোগী মারা যাওয়া আগে কোনো রোগের ক্ষেত্রে আমি দেখিনি।' তিনি আরও বলেন, 'এটি কী ভাইরাস, সরকার চাইলে তা বের করতে পারবে। এজন্য মাশিয়া মারা যাওয়ার আগেই তার পাকস্থলি থেকে কিছু খাবার বের করে সংরক্ষণ করেছি। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট চাইলে এটি আমরা দিতে পারব। পরীক্ষা করলে কিছু জানা যেতেও পারে।' রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন বলেন, 'শিশু দুটির নিপাহ ভাইরাস রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। তারা কোন ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল তা এখনই বলা যাবে না। এজন্য নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলতেই থাকবে। রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি বিশেষজ্ঞ মেডিকেল টিম রাজশাহীতে পাঠানো হচ্ছে। নিপাহ ভাইরাস রিপোর্ট নেগেটিভ হওয়ার পরই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই দলটি দ্রম্নতই রাজশাহী পৌঁছাবে।' রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এএফএম শামীম আহম্মদ বলেন, 'পরীক্ষায় যখন কিছু পাওয়া গেল না, তখন আমিই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালকের (প্রশাসন) কাছে অনুরোধ করলাম, যেন একটা বিশেষজ্ঞ দলকে রাজশাহী পাঠানো হয়। তিনি বলেন, 'চার-পাঁচজনের এই বিশেষজ্ঞ দলটি সোমবার রাজশাহী পৌঁছে হাসপাতালে আসবেন, পাশাপাশি এলাকায়ও যাবেন। লোকজনের সঙ্গে কথা বলবেন। পরীক্ষার জন্য বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করবেন। বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করবেন।' রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক বলেন, 'আমরা আগে থেকেই নিপাহর সংক্রমণ রোধে কাঁচা খেজুর খাওয়া রোধে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছিলাম। কাঁচা খেজুর রস খাওয়া বন্ধ করেছি। আর ওই দুই শিশুর মৃতু্যর কারণ হিসেবে নিপাহ ভাইরাস ধারণা করা হচ্ছিল, সেটির রিপোর্ট নেগেটিভ এসেছে। এ নিয়ে আইইডিসিআর কাজ করছে। তবে খেজুর রস না খাওয়া এবং ফল ভালোভাবে পরিষ্কার খাওয়ার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করা হচ্ছে।' নগরীর বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনায় জানা গেছে, এই দুই শিশুর মৃতু্যতে তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বাংলা ট্রিবিউন