আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন নারীরাও

প্রকাশ | ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি রিপোর্ট
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে চলমান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন নারীরাও। রীতিমতো তুঙ্গে অবস্থান করতে থাকে আন্দোলন। বিক্ষোভ-সভা-সমাবেশ আর মিছিলে মিছিলে সেস্নাগানে সেস্নাগানে প্রকম্পিত হচ্ছিল রাজপথ। পুরুষদের সঙ্গে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন নানা বয়সি নারীরাও। তারা জীবন বাজি রেখে পুরুষদের মতোই আন্দোলন করতে থাকেন। পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ আর হাতে হাত মিলিয়ে আন্দোলন সংগ্রামে প্রকম্পিত করেছিলেন রাজপথ। রাত জেগে পোস্টার, ব্যানার আর ফেস্টুন লিখেন। পোস্টা সেঁটে দেন ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে। ব্যানার ফেস্টুন হাতে করতে থাকেন মিছিল। ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনে অনেক নারীই অসম্ভব রকমের সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ডা. হালিমা খাতুন, রওশন আরা বাচ্চু, রওশন আরা রেণু, সুফিয়া আহমেদ, তৈফুরা, সুফিয়া খান, ডক্টর শরীফা খাতুনসহ অনেকেই। ডক্টর সুফিয়া আহমদের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে গঠিত হয় 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'। পরিষদ থেকে ২১ ফেব্রম্নয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সভা, হরতাল, বিক্ষোভ মিছিলসহ নানা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ২১ ফেব্রম্নয়ারি বিকাল ৩টায় ছিল গণপরিষদের অধিবেশন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে স্মারকলিপি প্রদানের উদ্দেশ্যে গণপরিষদের দিকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার কর্মসূচিও ছিল। ছাত্রসমাজের এমন কর্মসূচিতে বিচলিত হয়ে পড়ে সরকার। তখন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নূরুল আমীন। তার সরকার ২০ ফেব্রম্নয়ারি থেকে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করেছিল আন্দোলন দমন করতে। ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত মোতাবেক ২১ ফেব্রম্নয়ারি সকাল থেকে ছাত্রছাত্রীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় জমায়েত হন। তার স্মৃতিচারণ থেকে আরও জানা যায়, তার ওপর দায়িত্ব পড়েছিল আনন্দময়ী ও বাংলাবাজার স্কুলের মেয়েদের জড়ো করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় নিয়ে আসার। তিনি কাজটি সফলতার সঙ্গে করেন। সিদ্ধান্ত হয়েছিল, ছেলেরা ১০ জন করে এবং মেয়েরা চারজন করে বের হয়ে পুলিশের ব্যারিকেড পার হয়ে এগিয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, প্রথমে ছাত্রদের দুটি দল মিছিল নিয়ে বের হলে পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে ট্রাকে তুলে। তৃতীয় দল নিয়ে বের হন মেয়েরা। কিছু দূর যাওয়ার পর পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে। একের পর এক টিয়ার শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। তিনি সামান্য আহত হন। ডক্টর হালিমা খাতুন ছিলেন ভাষা আন্দোলনের অংশগ্রহণকারীদের অন্যতম। তার স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়, ১৪৪ ধারা ভাঙা নিয়ে তুমুল উত্তেজনা তৈরি হয় তাদের মধ্যে। তার ওপর দায়িত্ব ছিল মুসলিম গার্লস স্কুল এবং বাংলাবাজার গার্লস স্কুল থেকে মেয়েদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় জড়ো করা। ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তার দল ছিল মেয়েদের প্রথম দল। পুলিশ পথ আটকালে তারা পুলিশের রাইফেল ঠেলে সেস্নাগান দিতে দিতে এগিয়ে যেতে থাকেন। পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে। তারা বিন্দুমাত্র পিটু হটেননি এমনকি দমেননি। বরং ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সি থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে আবার রাস্তায় নেমে আসেন। এরপর তারা গণপরিষদ ভবনের দিকে যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারেননি তারা। শুরু হয় পুলিশের গুলিবর্ষণ। রওশন আরা বাচ্চু সেদিনের স্মৃতিচারণ করে বলেছেন, তিনি দেখতে পান, ছাত্রদের দুটো দল পুলিশের ব্যারিকেড টপকে চলে যায়। এরপরই তিনি অন্যদের নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তাকে সামনে পেয়ে পুলিশের লাঠির আঘাত এসে পড়ে তার ওপরে। তিনি পুলিশের এলোপাতাড়ি লাঠিপেটায় আঘাতপ্রাপ্ত হন। পুলিশ গুলিবর্ষণ শুরু করলে রাস্তার পাশের একটি পুরানো রিকশার গ্যারেজের আড়ালে অবস্থান নেন। সন্ধ্যার দিকে সেখান থেকে ছাত্রী হোস্টেলে ফিরেন। একুশের প্রথম শহীদ ছিলেন রফিক উদ্দীন। তার মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। ঘটনার পরপরই মেডিকেল কলেজের ছাত্রী হালিমা খাতুনের সহযোগিতায় এই ঐতিহাসিক দৃশ্যের ছবি তোলেন আমানুল হক কাজী ইদ্রিস। সেদিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আহতদের সেবা দিতে গিয়ে ক্রোধে ফেটে পড়েছিলেন হাসপাতালের সেবিকা মেয়েরা। প্রতিরোধের জায়গাটি এভাবে তাদের সহযোগিতা, সমর্থনে দীপ্ত হয়ে উঠেছিল।