শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

উপসচিব পরিচয়ে চার কোটি টাকা আত্মসাৎ

মূল হোতাসহ আটক ২
যাযাদি রিপোর্ট
  ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মো. আসাদুজ্জামান মানিক ও আব্দুল গফফারকে বিভিন্ন স্থান থেকে আটক করে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর একটি দল

বরগুনা সদরের পূর্ব হাজার বিঘা বটতলা সিনিয়র মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত হলেও কয়েকজন শিক্ষকের বিল আটকে ছিল। প্রতিষ্ঠানটির প্রিন্সিপাল মো. আব্দুস সালাম অনেক চেষ্টা তদবির করছিলেন শিক্ষকদের বিল করানোর জন্য। তদবিরের খবরে নিজে থেকে যোগাযোগ করেন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের উপ-সচিব ও প্রোগ্রাম অফিসার পরিচয়ে দেওয়া দুজন ব্যক্তি। তারা হলেন- জুবায়ের ওরফে মো. আসাদুজ্জামান মানিক ওরফে লুৎফর রহমান (৪৭) এবং আব্দুল গফফার ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে সাইফুল (৭৭)।

কয়েক দফায় ২০২১ সালে ওই দুজন ব্যক্তি মোট ১৪ লাখ টাকা নিলেও বিল হয়নি। যোগাযোগ না করে বদলে ফেলেন সিমও। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর সন্দেহ হলে খোঁজ-খবর নেন প্রিন্সিপাল আব্দুস সালাম। জানতে পারেন জুবায়ের বা আসাদুজ্জামান মানিক এবং আব্দুল গফফার বা সুমন চৌধুরী নামে কেউ মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে কোনো কর্মকর্তা নেই।

শুধু প্রিন্সিপাল আব্দুস সালামই নয়, এ রকম সারাদেশের অন্তত দুই ডজন মাদ্রাসা শিক্ষককে প্রতারণার ফাঁদে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার পরিচয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। কেউই টাকা ফেরত পাননি। প্রতারণার শিকারদের একজন বাদী হয়ে ২০২৩ সালের ৯ ডিসেম্বর বংশাল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করছিল পিবিআই।

রোববার দুপুরে আগারগাঁওস্থ পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান অতিরিক্ত ডিআইজি মো. জাহাঙ্গীর আলাম।

তিনি বলেন, তদন্তে প্রাপ্ততথ্য ও প্রতারিতদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জুবায়ের ওরফে মো. আসাদুজ্জামান মানিক ওরফে লুৎফর রহমানকে গত ১৫ ফেব্রম্নয়ারি রাত ২টায় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ থানার ফলগাছা গ্রাম থেকে এবং তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপর সহযোগী আব্দুল গফফার ওরফে সুমন চৌধুরী ওরফে সাইফুলকে রাজধানীর উত্তরা-পশ্চিম থানা এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) একটি দল।

অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের ভুয়া উপ-সচিব, প্রোগ্রাম অফিসার কখনো সিস্টেম অ্যানালিস্টের পরিচয়ে

মাদ্রাসার শিক্ষকদের টার্গেট করে তারা। এরপর এমপিওভুক্তি ও নব নিয়োগপ্রাপ্ত লাইব্রেরিয়ানদের বেতন ভাতাদি নিয়মিত করে দেওয়ার আশ্বাসে ৪ কোটির বেশি টাকা প্রতারণা করে আত্মসাৎ করেছে চক্রটি।

তিনি আরও বলেন, তদন্তে আমরা এখন পর্যন্ত প্রতারক চক্রটির খপ্পরে পড়ে ভোলা চরফ্যাশনের কুচিয়ামোড়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার মো. কামরুজ্জামানসহ আছলামিয়া হামেলা খাতুন বালিকা দাখিল মাদ্রাসা, দক্ষিণ চরফ্যাশন শামছুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা, আমিনাবাদ হাকিমিয়া দাখিল মাদ্রাসা, আছলামপুর মোহাম্মদীয়া দাখিল মাদ্রাসা, দক্ষিণ আছলামপুর মোবারক আলী দাখিল মাদ্রাসা, কুন্ডের হাওলা রাশিদীয়া দাখিল মাদ্রাসা, নূরাবাদ হোসাইনীয়া ফাজিল মাদ্রাসা, লালমোহন ইসলামীয়া কামিল মাদ্রাসা, উওর চরমানিকা লতিফীয়া দাখিল মাদ্রাসা এবং পূর্ব ফরিদাবাদ ইউনূসীয়া জিহাদূল উলূম দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক প্রিন্সিপাল ও সুপাররা প্রতারিত হয়েছেন বলে জেনেছি। এর বাইরে আরও ভুক্তভোগী রয়েছে।

চক্রটি আসলে টার্গেট করে করে খোঁজ নিয়ে ফাঁদ পেতে প্রতারণা করত। এই চক্রের সম্পর্কে জানা যায় ২০২৩ সালে। তবে তারা ২০১৯ সাল থেকে এ ধরনের অভিনব প্রতারণায় জড়িত।

অতিরিক্ত ডিআইজি জাহাঙ্গীর বলেন, এমপিওভুক্তি বাতিল করার ভয়-ভীতি দেখিয়ে এবং এমপিওভুক্তি বহাল রাখা, আবার কোনো মাদ্রাসার নব-নিযুক্ত লাইব্রেরিয়ানদের বেতন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শাখা থেকে নিয়মিত করে দেওয়ার কথা বলে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও সুপারদের গ্রেপ্তার আসাদুজ্জামান মানিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ঢাকায় ডাকা হয়। সচিবালয়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে অফিসার পরিচয়ে ১১ লাখ ৫১ হাজার টাকা নেন জোবায়ের

এরপর ২০২১ সালের ২ আগস্ট ওইসব মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও সুপারদের বিশ্বাস করে সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশ সচিবালয়ের বিপরীতে ওসমানী মিলনায়তনের সামনে দেখা করেন জোবায়ের রহমান। সচিবালয়ের ভেতর থেকে বাইরে এসে তিনি নিজেকে জোয়াবের রহমান, প্রোগাম অফিসার, কারিগরি ও মাদ্রাসা শাখা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় হিসেবে পরিচয় দেন।

এরপর ভোলা চরফ্যাশনের কুচিয়ামোড়া ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল কামরুজ্জামানসহ অন্যান্য মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও সুপারসহ গাড়িতে উঠে বংশাল থানার রায় সাহেব বাজারের সামনে যান।

সেখানে ১২ লাখ টাকা চান জোবায়ের। সেদিন নগদ দেওয়া হয় ৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা। বাকি টাকা চারটি মোবাইল নম্বরে নগদ ও বিকাশের মাধ্যমে আরও মোট ৪ লাখ ৬১ হাজার ১০০ টাকা পাঠান শিক্ষকরা।

পিবিআইয়ের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, টাকা দিয়েও কাজ না হওয়ায় ও সব মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বন্ধ হয়ে যায় ও নিয়োগপ্রাপ্ত লাইবেরিয়ানদের বেতনের অগ্রগতি না দেখতে পেয়ে সবাই খোঁজ নিতে থাকেন। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে খোঁজ-খবর নিয়ে তারা জানতে পারেন জুবায়ের ওরফে আসাদুজ্জামান মানিক নামে কোনো প্রোগ্রাম অফিসার কর্মরত নেই।

জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ভুক্তভোগী শিক্ষকরা নিরূপায় হয়ে এক রকম রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলেন। না টাকা ফেরত পাচ্ছিলেন, না বেতন-ভাতা। পিবিআই মামলাটি তদন্তের ভার নিয়ে দুই মাসের মধ্যেই মূল দুই প্রতারককে গ্রেপ্তার করে। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আদালতে উপস্থাপন করলে আদালত আসামিদের দুদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে পিবিআই এ কর্মকর্তা বলেন, বরগুনার পূর্ব হাজার বটতলা সিনিয়র মাদ্রাসা থেকে ১৩ লাখ ৭০ হাজার টাকা, বাগাতিপাড়া টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউট নাটোর থেকে ৮৫ হাজার টাকা, ভোলার উত্তর চরমানিকা লতিফীয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে ১১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, জয়পুরহাট মোহাব্বতপুর আমিনিয়া ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকাসহ আরও অন্যান্য মাদ্রাসার শিক্ষকদের এমপিওভুক্তি বাতিল করার ভয়-ভীতি দেখিয়ে বিভিন্ন বিকাশ ও নগদ নম্বরে মোট ৪ কোটি ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৭২ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য আমরা পেয়েছি।

মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তার এখানে যোগসাজশ রয়েছে কি না জানতে চাইলে পিবিআইয়ের অতিরিক্ত ডিআইজি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমরা সে রকম কোনো তথ্য পাইনি। তবে এখানে জুবায়ের ওরফে আসাদুজ্জামান মানিক মূলহোতা। তিনি আব্দুল গফফারকে নানা পরিচয়ে ব্যবহার করতেন। ২০১৯ সাল থেকে তারা শতাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষককে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। এ রকম আরও অজানা ভুক্তভোগী শিক্ষকদের আমরা যোগাযোগের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

যা বলছেন ভুক্তভোগীরা: পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) কার্যালয়ে কথা হয় ভুক্তভোগী বরগুনা সদরের পূর্ব হাজার বিঘা বটতলা সিনিয়র মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মো. আব্দুস সালামের সঙ্গে। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠানের ৬ জন শিক্ষকের বিল আটকা ছিল। কখনো ভাবিনি এই বিল পাস করতে গিয়ে ফাঁদে পড়ব। সচিবালয়ের সামনে সাক্ষাৎ করেছি। ১৪ লাখ টাকা দিয়েছি। বিল তো হয়নি উল্টো পথে বসার দশা হয়েছে। আর কেউ যেন এভাবে লেনদেন না করেন অনুরোধ জানান তিনি।

আরেক ভুক্তভোগী ভোলা চরফ্যাশনের উত্তর চরমানিকা লতিফিয়া দাখিল মাদ্রাসা সুপার মো. সালেহ উদ্দিন বলেন, সাত প্রতিষ্ঠানের জন্য যৌথভাবে ১১ লাখ ৫২ হাজার টাকা দিয়েছিলাম। কথা হয়েছিল লাইব্রেরিয়ানদের বিল করে দেবে। ২০২১ সালের ওই লেনদেনের কদিন বাদেই হাওয়া হয়ে যান তারা।

তিনি বলেন, মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ পেয়ে যখন মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরে খোঁজ নিতে থাকি টের পেয়ে একটা ভুয়া চিঠি ধরিয়ে দেয়। সেটিতে বিল হয়নি। যোগাযোগও আর হয়নি। শেষমেষ পিবিআইয়ের দারস্থ হয়ে দুই প্রতারকের দেখা পেলাম। মাদ্রাসা সুপার মো. সালেহ উদ্দিন গ্রেপ্তার দুজনের সর্বোচ্চ ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে