শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১

আমার অভিমানী ছেলের কথা বলা চিরতরে থেমে গেল

নিহত মামুনের মায়ের আহাজারি
আকাশ আহম্মেদ সোহেল, রাজৈর (মাদারীপুর)
  ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আমার অভিমানী ছেলের কথা বলা চিরতরে থেমে গেল

'মামুনকে বিদেশে পাঠাবো না বলায় সে অনেকদিন বাড়ি এসে খাবার খায়নি। কারো সঙ্গে কথাও বলেনি। উপায় না দেখে তাকে বিদেশ যেতে দিয়ে এখন চিরতরে বন্ধ হয়ে গেল তার খাবার খাওয়া। আমার অভিমানী ছেলেটার কথা বলাও থেমে গেল জন্মের মতো'- সন্তান হারিয়ে এভাবেই আক্ষেপ করে কথাগুলো বলছিলেন আর বার বার মুর্ছা যাচ্ছিলেন নিহত মামুনের মা হাফিজা বেগম। অবৈধভাবে সমুদ্রপথে ইতালি যাওয়ার সময় ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে মারা গেছেন মাদারীপুরের তিন যুবক। এদেরই একজন রাজৈর উপজেলার পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের মামুন শেখ। তিন যুবক মারা যাওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকেই নিহতদের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।

শুক্রবার দুপুরে মৃতু্যর খবর আসা ওই তিন যুবকের মধ্যে একজন সদর উপজেলার এবং অন্য দুজন রাজৈর উপজেলার বাসিন্দা। তারা হলেন- সদর উপজেলার পাঁচখোলা ইউনিয়নের পশ্চিম পাঁচখোলা গ্রামের আলী আকাব্বরের ছেলে সম্রাট (২৫), রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২১) ও সেনদিয়া

গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগী (২৫)।

শনিবার স্বরমঙ্গল গ্রামে মামুনের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র। সন্তান হারানোর শোকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এ পরিবারের ঋণ পরিশোধের দুশ্চিন্তা।

নিহতের মা হাফিজা বেগম বলেন, 'আমরা কেউই তাকে ইতালি পাঠাতে চাইনি। তবুও জোর করে, আমাদের বাধ্য করে সে অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সময় জীবনটাই শেষ করে দিল, একটাবার আমার বাবার (মামুন) মুখটা দেখতে চাই।'

তিনি বলেন, 'আমরা চেয়েছিলাম পড়াশোনা শেষ করে দেশেই একটি চাকরি করে জীবন যাপন করুক সে। কিন্তু তার বন্ধু-বান্ধব ও আশপাশের বেশিরভাগ মানুষ ইতালিতে পাড়ি জমানোর কারণে আমার ছেলেও অতি উৎসাহী হয়ে আমাদের ওপর চাপ দিয়ে বাধ্য করেছে টাকা দিতে। ওর বাবা ২০ বছর গ্রিসে থাকে। তাই আমরা কখনো চাইনি ছেলেরা প্রবাসে থাকুক।'

নিহত মামুন শেখের বড় ভাই সজিব শেখ জানান, 'মানবপাচারকারী চক্রের সক্রিয় সদস্য গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার রাঘদী ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের বাদশা কাজীর ছেলে মোশারফ কাজী প্রলোভন দেখিয়ে প্রত্যেকের কাছ থেকে ১৩-১৫ লাখ টাকা করে নেয়। পরে অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ইতালি পাঠালে এই দুর্ঘটনা ঘটে। সরকারিভাবে তাদের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছি। আমার ভাইয়ের মুখটা শেষবারের মতো দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করছি।'

জানা যায়, গত ১৪ জানুয়ারি মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার খালিয়া ইউনিয়নের পশ্চিম স্বরমঙ্গল গ্রামের ইউসুফ আলী শেখের ছেলে মামুন শেখ (২১) ও সেনদিয়া গ্রামের সুনীল বৈরাগীর ছেলে সজল বৈরাগীসহ বেশ কয়েকজন যুবক ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হন।

গত বুধবার লিবিয়া থেকে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকায় রওনা দেয় তারা। ৩২ জন ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন নৌকায় ৫২ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে নিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে তিউনিসিয়ার ভূমধ্যসাগরে নৌকার ইঞ্জিন ফেটে যায়। এতে মামুন ও সজলসহ মারা যায় ১২ জন। পরে খবর পেয়ে বেশ কয়েকজনকে জীবিত উদ্ধার করে স্থানীয় কোস্টগার্ড।

নিহতের পিতা-মাতা তাদের আদরের সন্তান হারিয়ে দিশাহারা। এ ঘটনায় দালালের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন নিহতদের স্বজন ও এলাকাবাসী। আর পুলিশ বলছে, লিখিত অভিযোগ পেলে নেওয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা।

নিহত সজল বৈরাগীর বাবা সুনীল বৈরাগী বলেন, 'নৌকা ডুবিতে প্রাণে বেঁচে যাওয়া একজন ফোন করে মামুন ও আমার ছেলে সজলের মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।'

তিনি বলেন, 'জমি, গরু বিক্রি করে, লোন করে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ছেলেকে ইতালি যাওয়ার জন্য পাঠাই। কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্ন সত্যি হলো না। সব স্বপ্ন সাগরে শেষ হয়ে গেল। আমরা একেবারে পথে বসে গেছি। এখন আমরা কী করবো? আমার ছেলে গেল, সঙ্গে আমাদের সব শেষ হয়ে গেল। এ ঘটনায় আমরা দালাল মোশারফ কাজীর কঠিন বিচার চাই।'

নিহত দুই যুবকের স্বজনরা জানান, গত ১৪ জানুয়ারি মামুন শেখ ও সজল বৈরাগীসহ বেশ কয়েকজন যুবক ইতালির উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হয়। দালালরা তাদের লিবিয়া নিয়ে রাখে।

তবে অভিযুক্ত দালাল মোশারফ কাজী লিবিয়ায় থাকায় তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। তার ছেলে যুবরাজ কাজীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটিও বন্ধ পাওয়া গেছে। এছাড়া আত্মগোপনে থাকায় দালাল রাশেদ খান ও টুলু খানদের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

রাজৈর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসাদুজ্জামান হাওলাদার আসাদ জানান, এ ব্যাপারে অভিযোগ দিলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে