গোয়েন্দাদের চোখকে ফাঁকি দিতে বর্তমানে জাল টাকা তৈরি হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। ছাপা হওয়া জাল টাকা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। রোজা ও ঈদকে সামনে রেখে সক্রিয় হয়ে ওঠছে এর সঙ্গে জড়িতরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে জাল নোট কারবারিরা গ্রেপ্তার হলেও শাস্তি হওয়ার নজির নেই। যেটি জাল নোটের কারবারিদের মধ্যে উৎসাহ হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জাল নোটের বিস্তার ঠেকাতে সম্মিলিতভাবে অভিযান শুরু করেছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। এমন অস্থিরতার সুযোগটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে জাল নোটের কারবারিরা। তারা রোজার ঈদকে সামনে রেখে ব্যাপকভাবে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। জাল টাকার ব্যাপক বিস্তার ঘটলে দেশে রীতিমতো অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, কোনো গ্রামের মানুষের কাছে যদি ৫০০ বা ১০০০ হাজার টাকার একটি জাল নোট পড়ে, তাহলে তার অর্থনৈতিক অবস্থা বেহাল হয়ে পড়ে। এটি খুবই স্বাভাবিক। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজন জাল টাকা ও আসল টাকার মধ্যে তেমন পার্থক্য বুঝতে পারেন না। সেই সুযোগটিই নিতে তৎপর হওয়ার চেষ্টা করছে জাল নোটের কারবারিরা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ-কমিশনার মশিউর রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, রোজার ঈদ ও পূজা এবং বড় ধরনের জাতীয় উৎসবকে ঘিরে জাল নোটের কারবারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। কারণ, ওই সময় অর্থের লেনদেন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি হয়। যে কারণে এসব উৎসবকে ঘিরে ঢাকায় গোয়েন্দাদের নজরদারি তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি থাকে। এ জন্য জাল নোটের কারবারিরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে।
তারা ঢাকা ও বিভাগীয় শহর ছেড়ে জেলা-উপজেলা এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গিয়ে আস্তানা গাড়ছে। স্বাভাবিক ও যৌক্তিক কারণেই জেলা-উপজেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে গোয়েন্দা নজরদারি কম থাকে। সেই সুযোগটিকেই জাল নোটের কারবারিরা কাজে লাগাচ্ছে। তারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে আস্তানা গেড়ে জাল নোট তৈরি করছে। আর সেই নোট নানাভাবে ছড়িয়ে দিচ্ছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এমনকি খোদ ঢাকাতেও জাল নোট ছড়িয়ে দিচ্ছে।
এই গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলছেন, গত কয়েক বছরে ডিবির অভিযানে কমপক্ষে পাঁচ শতাধিক জাল নোট কারবারি গ্রেপ্তার হয়েছে। জব্দ হয়েছে তৈরি হওয়া অন্তত ১০০ কোটি টাকার জাল নোট। আর যে পরিমাণ কাঁচামাল
\হজব্দ হয়েছে, তা দিয়ে অন্তত এক হাজার কোটি টাকার জাল নোট তৈরি সম্ভব ছিল। জাল নোট তৈরি হয় কয়েকটি স্তরে। একটি গ্রম্নপ জাল নোট তৈরির কাঁচামাল সংগ্রহ করে। আরেকটি গ্রম্নপ শুধু কারখানা স্থাপন করে সেখানে জাল নোট তৈরি করে। আরেকটি গ্রম্নপ জাল নোট বিভিন্ন জায়গায় পরিবহণযোগে নিয়ে পৌঁছে দেয়। আরেকটি গ্রম্নপ মাঠপর্যায়ে জাল নোট ছড়িয়ে দেয় বা বিক্রি করে। আবার এই চক্রের অনেকেই নিজেরাও জাল নোট দিয়ে গ্রামাঞ্চল থেকে কেনাকাটা করে। এতে করে জাল নোটের পরিবর্তে আসল টাকা ও মালামাল পায়। সেই মালামাল আবার পাইকারি দোকানে বিক্রি করে আসল টাকা পায়। এতে করে দ্বিগুণ লাভ হয়।
তিনি বলেন, প্রতি লাখ জাল নোট পাইকারি হারে বিক্রি হয় ২০-২৫ হাজার টাকায়। এরপর প্রতি ধাপে এর দাম লাখপ্রতি ৫-১০ হাজার টাকা হারে বেড়ে যায়। প্রান্তিক পর্যায়ে প্রতি লাখ জাল নোট ৩০-৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। স্বাভাবিকভাবেই ৩৫ হাজার টাকায় কেনা লাখ টাকার জাল নোট চালিয়ে বা মালামাল কিনে ৬০-৭০ হাজার টাকা বিক্রি করতে পারলেও দ্বিগুণ লাভ হয়। এমন কাঁচা টাকার লোভ সামলাতে না পেরে অনেকেই জাল নোটের কারবার থেকে আর বের হতে পারেন না। গ্রেপ্তারদের অনেকেই ৫-৬ বারও গ্রেপ্তার হয়েছেন। জামিনে বেরিয়ে আবারও জাল নোটের কারবারে জড়িয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া জাল নোটের মামলায় কারও শাস্তি হওয়ার কোনো নজির আমার জানা নেই। যেটি অপরাধীদের এ ধরনের অপরাধ করতে মানসিকভাবে আরও সাহসী করে তুলে বলে আমার ধারণা।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ার সুযোগটিকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে জাল নোটের কারবারিরা। বিষয়টি ডিবির নজরে এসেছে। জাল নোটের কারবারিদের গ্রেপ্তারে অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, জাল নোটের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জাল নোটের বিস্তার ও জাল নোটের কারবারিদের বিষয়ে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত কয়েক বছরে কয়েকশ' বিদেশি গ্রেপ্তার হয়েছে জাল নোট কারবারে জড়িত থাকার অপরাধে। বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের বিষয়ে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। জাল নোটের বিস্তার ঠেকাতে প্রয়োজনে কম্বিং বা চিরুনি অভিযান চালানো হবে। এ ধরনের প্রস্তুতিও রয়েছে সিটিটিসির।
র্
যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে বলেন, ২০০৪ সালের ২৬ মার্চর্ যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে হালনাগাদ প্রায় তিন হাজার জাল নোট কারবারি গ্রেপ্তার হয়েছে। জব্দ হয়েছে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা সমমূল্যের জাল নোট। যার মধ্যে রয়েছে দেশি-বিদেশি নোটও। জাল নোট আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন করেছে সরকার। এরপরও চক্রের সদস্যরা কাঁচা টাকার লোভে এমন অপরাধ থেকে সরেনি। রোজা ও ঈদে জাল নোটের কারবারিরা বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। জাল নোটের বিস্তার ঠেকাতের্ যাবের অভিযান ও গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় গত ১৫ ফেব্রম্নয়ারি রাতে ঢাকার কদমতলী থেকে একজনকে দুই লাখের বেশি জাল নোটসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সিআইডির মিডিয়া বিভাগের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার আজাদ রহমান যায়যায়দিনকে বলেন, জাল নোটের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সিআইডির সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। এ ব্যাপারে সিআইডির বিভিন্ন টিম অভিযান অব্যাহত রাখার পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিপার্টমেন্ট অব কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট জাল ও অচল নোট প্রতিরোধ এবং পর্যালোচনা কোষ বিভাগ থেকে বিশেষ নির্দেশ জারি করেছে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে, রোজা, ঈদ বা বড় উৎসব এলেই জাল নোট কারবারিদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এ সময় লেনদেন বেড়ে যায়। সুযোগটিকে কাজে লাগাতে পারে জাল নোটের কারবারিরা। এ জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেন আগাম অভিযান শুরু করে।
এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ব্যাংক জালমুদ্রার বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিটি বাণিজ্যিক ব্যাংক বরাবর নির্দেশনা জারি করেছে। নিদের্শনায় ব্যাংককে আসল নোটের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্য-সংবলিত ভিডিওচিত্র প্রতিটি ব্যাংকের শাখায় ও রাজধানীসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়েছে। পবিত্র রমজান মাসজুড়ে জনসমাগমস্থলে বা রাস্তার মোড়ে মোড়ে সন্ধ্যার পর কমপক্ষে এক ঘণ্টা এই ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করতে হবে। ঢাকাসহ সারাদেশের অন্তত ৫৬টি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভিডিও প্রচারের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক মো. মেজবাউল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি যায়যায়দিনকে বলেন, ইতোমধ্যেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ইসু্যতে রোজা ও ঈদে জাল নোটের বিস্তার ঠেকাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। বৈঠকে জাল নোটের বিস্তার ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তরফ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দারা কাজও শুরু করেছে।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালের ৬ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্যে ১৪ নম্বর চুক্তিটি হয় মাদক চোরাচালান ও জালমুদ্রা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে।
বিজিবি ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, এমন চুক্তির পর থেকেই দুই দেশেই জালমুদ্রার কারবারিদের ধরতে পারস্পরিক যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান এবং কম্বিং অপারেশন অব্যাহত রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক দুই দেশেই অনেক অভিযান পরিচালিত হয়েছে। গ্রেপ্তারও হয়েছে জাল নোটের অনেক মাস্টারমাইন্ড। জাল নোটের আগ্রাসন কমাতে পার্শ্ববর্তী একটি দেশের নাগরিকদের যাতায়াতের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। দেশটি জালমুদ্রার মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক মেরুদন্ড দুর্বল করে দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।