রাখাইনে সংঘাত

ওপারের ভারী গোলার শব্দে কাঁপছে টেকনাফের ঘরবাড়ি

স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছেন না সীমান্তবর্তী মানুষ ওপারে যতই গোলাগুলি হোক, কাউকে আসতে দিচ্ছি না :স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
মিয়ানমার জান্তা সেনাদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের চলমান সংঘাতের মধ্যে গত তিন দিন ধরে কক্সবাজারের উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার সীমান্ত পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। তবে টেকনাফ সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে বৃহস্পতিবার রাতভর থেমে থেমে গোলাগুলির আওয়াজ শোনা গেছে। শুক্রবার সকালে ওপারের মর্টার শেলের বিকট দু'টি শব্দে কেঁপে ওঠে টেকনাফ সীমান্তের ঘরবাড়ি। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, সীমান্তের পরিস্থিতি বর্তমানে এই ভালো তো এই খারাপ। এমন সংঘাতময় পরিস্থিতির কারণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে সীমান্তবর্তী মানুষের মধ্যে। স্বজন হারানোর শোক কিংবা গুলির ক্ষত বয়ে বেড়ানো সীমান্তবাসীরা ফিরতে পারছেন না স্বাভাবিক জীবনে। এদিকে, সীমান্তের সার্বিক পরিস্থিতির আলোকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, মিয়ানমার থেকে কেউ বাংলাদেশে অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। সীমান্তের বিজিবির ফোর্স বাড়ানো হয়েছে। কোস্ট গার্ড, পুলিশ ও নৌবাহিনী সজাগ রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, ২ ফেব্রম্নয়ারি রাত থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সংঘর্ষ তীব্রতর হয়। ইতোমধ্যে বিজিপিকে হটিয়ে তুমব্রম্ন রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্তচৌকি দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। জান্তা সেনা ও বিদ্রোহীদের ব্যাপক সংঘর্ষের মধ্যে মিয়ানমারের গুলি ও মর্টার শেল এদেশের ভূখন্ডে এসে পড়ে। ৫ ফেব্রম্নয়ারি নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুজন নিহত হন। নিহত দুজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। এ ছাড়া গোলাগুলিতে আহত হন ৯ জন। স্থানীয়রা জানান, শুক্রবার ভোর থেকে দুপুর পৌনে ২টা পর্যন্ত টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা, সাবরাং ও সেন্টমার্টিন সীমান্তে ভারী মর্টার শেলের শব্দ পায় স্থানীয় বাসিন্দারা। মর্টার শেলের আঘাতে এপারের সীমান্তে লোকজনের বাড়িঘর কাঁপছে। টেকনাফ পৌরসভার নাফ নদের কাছাকাছি বসবাস করা মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, 'শুক্রবার ভোর থেকে থেমে থেমে মিয়ানমার সীমান্তে বড় ধরনের গোলার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। শব্দের আতঙ্কে অনেকের ঘুম ভেঙেছে। সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের বশিপাড়া (বকশিপাড়া) গোলার বিকট শব্দ হচ্ছে। যার কারণে আমাদের ঘরবাড়ি কাঁপছে। অনেক সময় মনে হয় ভূমিকম্প হচ্ছে।' জানা গেছে, সীমান্ত উপজেলায় হ্নীলা থেকে দমদমিয়ার ৮, ৯ ও ১০ নম্বর পিলার এবং সাবরাংয়ের ৩-৭ নম্বর পিলারের ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি ও জান্তা সরকারের মধ্যে সংঘর্ষে মর্টার শেল, গুলির শব্দে কেঁপে উঠছে টেকনাফের হ্নীলা, শাহপরীর দ্বীপ ও সেন্টমার্টিন। এ বিষয়ে টেকনাফ-২ বিজিবি অধিনায়ক লে. কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ বলেন, 'সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ব্যাপক গোলাগুলির খবর পেয়েছি। ফলে আমরা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ-সেন্টমার্টিনসহ সীমান্তে টহল বৃদ্ধির পাশাপাশি নজরদারি বাড়িয়েছি। এ ছাড়া বৃহস্পতিবার স্থানীয়দের মাধ্যমে শাহপরীর দ্বীপের ওপারে মিয়ানমারের মংডুতে হেলিকপ্টার ওড়ার খবর পেয়েছি।' তিনি বলেন, 'সীমান্তের ওপারের গ্রামগুলোতে দেশটির জান্তা সরকার এবং আরাকান আর্মির মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ চলছে। দু'পক্ষই ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করছে। এতে সীমান্তে থাকা বাড়িঘর কেঁপে উঠছে। তবে সীমান্তে আমাদের বিজিবি টহল জোরদার করা হয়েছে।' সীমান্তে নজর রাখেন এমন এক সরকারি কর্মকর্তা বলেন, 'টেকনাফ সীমান্তের ওপারে জান্তা সরকার এবং আরাকান আর্মির মধ্যে সংঘর্ষ বাড়ছে। এতে সীমান্তের লোকজনের মধ্যে ভয় কাজ করছে। সকালে মর্টার শেলের ভারী শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে। মনে হচ্ছে আমাদের অফিসের ছাদের ওপর পড়েছে। কারণ ওপারের বিকট শব্দে এপারে ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠছে।' সীমান্তের মানুষজন বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাত চলছিল। মাঝপথে বন্ধ হলেও গত সপ্তাহ ধরে সীমান্তের জনপদ আবারও অশান্ত হয়ে ওঠে। বিশেষ করে টেকনাফ সীমান্তের হ্নীলা, সাবরাং ও সেন্টমার্টিনে নাফ নদের বিপরীতে মিয়ানমার সীমান্তে প্রতিদিনই গোলাগুলি-মর্টার শেলের শব্দ পাচ্ছে সীমান্তের লোকজন। তবে প্রায় সময় হ্নীলার জাদিমুড়া, দমদমিয়া, মৌলভীবাজার, ফুলের ডেইল সাবরাংয়ের নয়াপাড়া, মৌলভীপাড়া, নাজিরপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের জালিয়াপাড়া, চৌধুরীপাড়া, দক্ষিণ জালিয়াপাড়া এলাকার নাফ নদের সীমান্তে থেমে থেমে ভারী গুলিবর্ষণের বিকট শব্দ শুনতে পান তারা। শাহপরীর দ্বীপ সীমান্তের বাসিন্দা মো. রাসেল বলেন, 'ভোর থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘর্ষে গোলাগুলির বিকট শব্দ পাচ্ছি। দ্বীপের সাধারণ মানুষ আতঙ্কে রয়েছে। এর আগে কখনও সীমান্তে এভাবে গোলার শব্দ শোনা যায়নি। ওপারের গোলার আঘাতে এপারের ঘরবাড়ি কাঁপছে। এখন পর্যন্ত নতুন কোনো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেনি তবে নতুনভাবে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের সম্ভাবনা বেশি।' টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, 'ওপারে গোলার শব্দ আমার বাড়ি পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। সীমান্তে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলো সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। এটা সত্য, সীমান্তের মানুষের মাঝে ভয় কাজ করছে। তবে আমরা সীমান্তের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছি।' অস্ত্র নিয়ে কেউ প্রবেশ করতে পারবে না এদিকে, শুক্রবার বিকালে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, 'শুধু আরাকান আর্মি নয় গোটা মিয়ানমারে বিভিন্ন গ্রম্নপ যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। আরাকান আর্মির গোলাগুলির শব্দ আসছে, সেটা সত্য। ওখানকার সরকারি বাহিনী বিজিপি এবং সরকারি অন্যান্য লোকজন ভয়ে আত্মরক্ষার্থে আমাদের দেশে পালিয়ে এসেছে। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির একটি কথা ছিল, ফ্রেন্ডশিপ উইথ অল, ম্যালাইজ উইথ নান; আমরা এই নীতি অবলম্বন করছি। তারা যতই গোলাগুলি করুক, তাদের প্রতিবাদ করছি, আমরা তাদের এখানে ঢুকতে দিচ্ছি না। পরিত্যক্ত অবস্থায় কিছু অস্ত্র বিজিবি উদ্ধার করেছে। এগুলো হয়তো আরাকান আর্মি হয়তো কোনো মোটিভ থাকতে পারে। তাদের সবাইকে বিজিবি আটক করেছে। তবে কেউ আর অস্ত্র নিয়ে এদেশে প্রবেশ করতে পারবে না। সীমান্তের বিজিবির ফোর্স বাড়ানো হয়েছে। কোস্ট গার্ড, পুলিশ ও নৌবাহিনী সজাগ রয়েছে।'