ট্রেজারি বিল ও বন্ড থেকেও বেশি সুদে ঋণ নিচ্ছে
স্বল্পমেয়াদি ঋণে ঝুঁকছে সরকার
প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় মেটাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণে ঝুঁকছে সরকার। খরচের তুলনায় রাজস্ব আয় কম হওয়ায় উচ্চ সুদে এসব ঋণের দিকে ঝুঁকছে। এজন্য সরকার ট্রেজারি বিল ও বন্ড থেকে আকর্ষণীয় সুদে ঋণ নিচ্ছে। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ব্যাংক খাতে আমানতের সুদের হার গড়ে সাড়ে ৭ শতাংশ। অনেক ব্যাংক এর চেয়েও কম সুদ দিচ্ছে। কিন্তু সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে গড়ে ১১.৮ শতাংশ সুদ মিলছে। একইভাবে সঞ্চয়পত্রে সুদের হার পাওয়া যাচ্ছে ১১ শতাংশের বেশি। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প ও রাজস্ব খরচ যেভাবে হচ্ছে তাতে ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদ আরও বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সূত্র মতে, দুই বছর মেয়াদি বিল ও বন্ড থেকে ১১.৮ শতাংশ সুদ দিচ্ছে সরকার। অথচ ৫ বছর মেয়াদি বা ততোধিক মেয়াদের ক্ষেত্রে সুদ মাত্র ১৩ শতাংশ। ব্যাংকিং সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, সরকারের টাকার প্রয়োজন আরও বাড়বে। সেক্ষেত্রে দুই বছর মেয়াদি বন্ড ও বিলের সুদ ১৩ শতাংশ পর্যন্ত ওঠে যেতে পারে। যদি দুই বছর আর ৫ বছরের অধিক সময়ের সুদ একই সমান হয়, তখন বুঝতে হবে সরকারের স্বল্পমেয়াদে টাকা প্রয়োজন বেশি। সরকার দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে থাকে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ নেয় ট্রেজারি বন্ড ও বিলের মাধ্যমে। আর সামান্য কিছু নিয়ে থাকে সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে। আগে সঞ্চয়পত্র ছাড়া সাধারণ মানুষের অন্য কোথাও বিনিয়োগ করার সুযোগ ছিল না, বর্তমানে ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ব্রোকারেজ হাউজের মাধ্যমে বিক্রি হচ্ছে। ফলে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া সাধারণ জনগণ কিনতে পারছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পসহ সরকারের দৈনন্দিন আয় মেটাতে যে পরিমাণ রাজস্ব থেকে আয় হওয়ার কথা সেটি হচ্ছে না। ফলে সরকারকে ব্যাংকিং খাত থেকে ধার করতে হয়। এদিকে ব্যাংকিং খাত থেকে সরকারি বন্ডের সুদ বেশি হওয়ায় অনেক ব্যাংক গ্রাহকদের কাছ থেকে আমানত নিয়ে সরকারকে দিচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলো কোনো ঝুঁকি না নিয়েও গ্রাহকের টাকা খাটিয়ে ব্যবসা করছে। সরকারি বন্ডে বিনিয়োগ করা একেবারেই ঝুঁকিমুক্ত। কারণ সরকার কখনো দেউলিয়া হয় না। অর্থ সংকট থাকলে টাকা ছাপানোর ক্ষমতা সরকারের রয়েছে। আকর্ষণীয় হারে সুদ দেওয়ায় ব্যাংকগুলো বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছে। অন্যদিকে সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণের চাপ বাড়ছে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সরকারের নেওয়া পুঞ্জীভূত ঋণ ৮ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এক বছরে দেশীয় উৎস থেকে সরকারের নেওয়া ঋণের পরিমাণ এক লাখ কোটি টাকা বেড়েছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে সরকারের অভ্যন্তরীণ উৎসের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ৫ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা, যা ২০২৩ সালের একই মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৯ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, বিল-বন্ডের মাধ্যমে সরকারের ধারের পরিমাণ বেড়েছে। গত ১৮ নভেম্বর থেকে ২৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন মেয়াদি বিল বন্ডের মাধ্যমে সরকার প্রায় সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা তুলেছে। এদিকে গত অক্টোবরের শেষে ব্যাংক থেকে নেওয়া সরকারের পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩ লাখ ৮২ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা। আর ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে নেওয়া পুঞ্জীভূত ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৪ লাখ ২৭ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা। গত জুলাই-অক্টোবরে সরকার ব্যাংকবহির্ভূত খাত থেকে ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে এ খাত থেকে সরকারের প্রকৃত ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২ হাজার ৭২৫ কোটি টাকা। সরকার সঞ্চয়পত্র, বিল ও বন্ড বিক্রি করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেয়। সঞ্চয়পত্র থেকেও সরকার খুব বেশি ঋণ পাচ্ছে না। তাই সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে ৪৯ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা আরও কমিয়ে ১৮ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এটি চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাত থেকে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় ৪৯ শতাংশ কম। এবারের লক্ষ্যমাত্রা বিগত ৭ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সরকার। ওই সময় প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ছিল ৪ লাখ কোটি টাকার সামান্য বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্রের সুদ প্রাক্কলন করা হয়েছিল ৪২ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটি বাড়িয়ে ৪৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, সরকারের বাজেট ব্যয় যেভাবে বাড়ছে, সেভাবে রাজস্ব আয় আসছে না। সেজন্য তো সরকারের কাজ আর থেমে থাকবে না। সরকারকে টাকার উৎস বের করতে হবে। তাই ট্রেজারি বন্ড ও বিলে মনোযোগ দিয়েছে। এ খাত থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও জনগণ একই সঙ্গে বিনিয়োগ করতে পারে।