গ্যাস সংকটের ধাক্কা গণপরিবহণে

প্রকাশ | ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

সাখাওয়াত হোসেন
অটোরিকশা চালক নিজামউদ্দিন বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে তিনটায় রাজধানীর মালিবাগের হাজীপাড়া ফিলিং স্টেশনে লাইন ধরলেও সোয়া চারটাতেও গাড়িতে গ্যাস ভরতে পারেননি। তার সামনে দীর্ঘ সারি থাকায় কতক্ষণে গ্যাস নিতে পারবেন তা-ও অনিশ্চিত। এ পরিস্থিতি শুধু ওই ফিলিং স্টেশনেই নয়, রাজধানীসহ দেশের প্রায় সবখানেই গত কয়েকদিন ধরে এ সংকট জেঁকে বসেছে। গ্যাস নিতে এই দীর্ঘসময় অপচয় হওয়ায় গণপরিবহণ মালিক-চালকরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি যাত্রীরাও পড়ছেন চরম ভোগান্তিতে। পাশাপাশি গ্যাস নেওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ গাড়ির লম্বা লাইনের কারণে ফিলিং স্টেশন সংলগ্ন ব্যস্ততম সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে দীর্ঘ যানজট। যা সামাল দিতে ট্রাফিক পুলিশও হিমশিম খাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা জানায়, গ্যাসের চাপ না থাকায় সিএনজিচালিত যানবাহনগুলোকে ফিলিং স্টেশনে ঘণ্টার পর ঘণ্টার লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। এতে নগরীর অধিকাংশ রুটে গণপরিবহণ সংকট দেখা দিয়েছে। পরিবহণ শ্রমিকদের খরচের টাকা তুলতে কষ্ট হচ্ছে। তিতাস কর্তৃপক্ষ সংকটের কথা স্বীকার করে জানিয়েছে, চাহিদা আর জোগানের সমন্বয় না থাকায় গ্যাস সরবরাহে সমস্যা হচ্ছে। শীত বিদায় নেওয়ায় বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলোতে আগের চেয়ে বেশি গ্যাস সরবরাহ করতে হচ্ছে। এ ছাড়া শিল্পকারখানাতেও গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় সেদিকেও নজর দিতে হয়েছে। গরম বাড়লে এ সংকট আরও তীব্র হতে পারে বলে খোদ তিতাসের অনেক কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ব্যবস্থাপক পর্যায়ের এক কর্মকর্তা যায়যায়দিনকে বলেন, জাতীয়ভাবে আমাদের গ্যাস সরবরাহ কম, এটা এখন জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যা কবে নাগাদ সমাধান হবে- আমরা জানি না। সমস্যার সমাধান উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। তিনি আরও বলেন, 'আমাদের সরবরাহের বিষয়টি নির্ভর করে দেশীয় উৎপাদন ও আমদানির ওপর। কিন্তু বেশ একটি লম্বা সময় ধরে দেশে আমদানীকৃত এলএনজি সংগ্রহের সমস্যা হচ্ছে। যার ফলে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এলএনজি আমদানি স্বাভাবিক না হলে এ সংকট কাটবে না। সংকট আরও বাড়লে সিএনজি স্টেশন বন্ধ রাখার সময় বাড়ানো হতে পারে।' খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে দেশে সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখের মতো। আর সিএনজি স্টেশনের সংখ্যা ৫০০টি। বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী ঢাকার ভেতরে মোট বাস ১২ হাজার ৫২৬টি। তার মধ্যে গ্যাসে চলে ১১ হাজার ৯০০টি। ঢাকা থেকে দূরপালস্নার বাস মোট ১৬ হাজার। তার মধ্যে গ্যাসে চলে ১১ হাজার ২০০। সারা দেশে মোট বাস ৭৮ হাজার। তার মধ্যে গ্যাসে চলে ৪৬ হাজার ৮০০টি। এ ছাড়া রয়েছে সিএনজিচালিত ব্যক্তিগত গাড়ি, অটোরিকশা। ফিলিং স্টেশনের মালিকরা জানান, সংকটের কারণে গাড়িতে ঠিকভাবে গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টাই গ্যাসের চাপ থাকে না। যখন থাকে ১ বা ২ পিএসআইর বেশি হয় না। ফলে প্রতিটি স্টেশনেই গ্যাস নেওয়ার জন্য দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এতে অনেকেই বিরক্ত হয়ে গাড়িতে সিএনজির পরিবর্তে এলপিজি গ্যাস ব্যবহার করছেন। গ্যাস না পাওয়ার কারণে বেশ কয়েকটি ফিলিং স্টেশন বন্ধ হয়ে গেছে। যারা কোনোভাবে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছেন তাদের আয় প্রায় ৫০ শতাংশ কমেছে। সিএনজি ফিলিং স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ফারহান নূর জানান, ফিলিং স্টেশনের মালিকরা ভয়াবহ বিপাকে পড়েছেন। গ্যাস না থাকায় ব্যবসা করতে পারছেন না। তারা যৎসামান্য গ্যাস পেলেও চাপ না থাকায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এ ব্যাপারে সরকারের কাছে ধরনা দিয়েও তারা কোনো সুফল পাচ্ছেন না। তিনি আরও জানান, এ খাতের ব্যবসায়ীদের অনেকেই ব্যাংক ঋণ নিয়ে এ খাতে বিনিয়োগ করেছেন। ব্যবসা না থাকায় ঋণ পরিশোধ করতে পারছেন না। তিতাসের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফিলিং স্টেশনের মেশিনে প্রতি ঘণ্টায় ৬০০ কিউবিক মিটার গ্যাস পাওয়ার কথা। সেখানে তারা প্রতি ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ১৬০ থেকে ১৭০ কিউবিক মিটার গ্যাস পাচ্ছে। আর প্রেসার ১৫ পিএসআই পাওয়ার কথা থাকলেও পাওয়া যায় ৬-৭ পিএসআই। আবার কখনো তা ২-৩ পিএসআইয়েও নেমে আসছে বলে ফিলিং স্টেশনের মালিকরা অভিযোগ করছেন। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকায় গ্যাসের সংকট বরাবরই ছিল। তবে এটি একটা পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়েছিল এলএনজি সরবরাহ ঠিক থাকায়। এখন একটি টার্মিনাল অপারেশনে নেই। যে কারণে গ্যাস সংকট কিছুটা বেড়েছে। রাজধানীতে রাইড শেয়ারিংয়ে গাড়ি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা মহব্বত আলী রাজধানীর সায়েদাবাদ এলাকার একটি ফিলিং স্টেশনে প্রায় এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও গ্যাস নিতে পারেননি। আক্ষেপের সুরে তিনি বলেন, 'গ্যাস নিতে দীর্ঘসময় লাগলে আমাদের চলা খুব কষ্ট হয়ে যাবে। কিভাবে চলব আমরা? আমরা তো এই গাড়ি দিয়ে ভাড়ায় যাত্রী পরিবহণ করি। উচ্চমূল্যের বাজারে নতুন করে এ সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে পরিবার নিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।' ডেমরার একটি ফিলিং স্টেশন অপেক্ষারত সিএনজি অটোরিকশা চালক শহীদুল বলেন, 'সিরিয়াল দিয়েছি ৪০ মিনিট আগে। এখনো গ্যাস পাইনি। গ্যাস থাকলেও প্রেসার নাই। ৫০০ টাকার গ্যাস নিয়ে গাড়ি চালাইছি মাত্র ৩৫ কিলোমিটার। এভাবে কি পোষাবে? না হলে একেবারে বন্ধ করে দেক।' গ্যাসের দীর্ঘলাইন এড়াতে কয়েকটি ফিলিং স্টেশনে গেলে সবখানেই একই অবস্থা বলে জানান শহীদুল। এদিকে পাঠাও-উবারের কার ও সিএনজি অটোরিকশায় যাতায়াতকারী যাত্রীরা জানান, গ্যাস সংকটে চালক দীর্ঘসময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার কারণে তাদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তারা তা পুষিয়ে নিতে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করছে। বৃহস্পতিবার সকালে সিএনজি অটোরিকশায় যাত্রাবাড়ী থেকে খিলগাঁওয়ের পুলিশ ফাঁড়ি এলাকায় আসা মটরপার্টস ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান জানান, স্বাভাবিক সময় তিনি প্রতিদিন আড়াইশ' টাকায় বাসা থেকে কর্মস্থলে আসেন। কিন্তু গত দু'দিন ধরে কোনো সিএনজি চালকই তিনশ' টাকার কমে এখানে আসতে চাইছে না। বাধ্য হয়ে এর আগে একদিন তিনি পাঠাও' এর মোটর সাইকেলে কর্মস্থলে এসেছেন। শুধু অটোরিকশা কিংবা উবার-পাঠাও'এর গাড়িতেই নয়, সিএনজিচালিত বাসেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে যাত্রীরা অনেকে অভিযোগ করেছেন। তবে পরিবহণ শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের দাবি, গ্যাস নিতে দীর্ঘ সময় লাগায় অধিকাংশ বাসেরই এক-দু'টি ট্রিপ মিস হচ্ছে। এ ক্ষতি পোষানোর জন্য কেউ কেউ যাত্রীদের কাছ থেকে দু'চার টাকা বেশি ভাড়া নিতে পারে। এজন্য গণহারে সবাইকে দায়ী করা ঠিক নয়। তবে এ অবস্থা চলমান থাকলে কিংবা সামনে গ্যাস সংকট আরও বাড়লে সিএনজিচালিত বাসগুলো ভাড়া বাড়াতে বাধ্য হবে বলে মন্তব্য করেন তারা। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর অধিকাংশ সড়কেই সিএনজি চালিত যানবাহনের সংখ্যা স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বেশ খানিকটা কম। ফলে সকাল ও বিকালের পিক-আওয়ারে বিভিন্ন পয়েন্টে গণপরিবহণের জন্য শত শত মানুষকে অপেক্ষা করছে। নিরূপায় হয়ে অনেকে পায়ে হেঁটে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হচ্ছেন। কেউবা বিকল্প পথ খুঁজে নিচ্ছেন। তবে বাস ছাড়া যাদের গন্তব্যে যাওয়ার সামর্থ্য নেই তারা তীর্থের কাকের মতো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। দীর্ঘসময় পর বাসের দেখা মিললে সবাই একসঙ্গে তাতে চড়ার যুদ্ধে নামছেন। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা জানান, পরিবহণ সংকট আগামীতে আরও বাড়তে পারে। কেননা গ্যাসের চাপ কম থাকায় এক একটি গাড়িতে জ্বালানি ভরতে আগের চেয়ে দুই থেকে তিনগুণ বেশি সময় লাগছে। তাই গাড়ির লম্বা লাইন ফিলিং স্টেশন ছাড়িয়ে রাস্তার অনেক দূর পর্যন্ত গিয়ে ঠেকছে। যে গাড়িতে একবারে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকার গ্যাস নেওয়া যায়, সে গাড়িতে ৩০০ টাকার বেশি গ্যাস দেওয়া যাচ্ছে না। তাই বেশিরভাগ গাড়ি দিনে অন্তত দুইবার গ্যাস স্টেশনে ভিড় করছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর প্রগতি সরণি এলাকার কয়েকটি সিএনজি ফিলিং স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, সবগুলোতেই গাড়ির লম্বা লাইন পড়েছে। তবে তা সামনে দিকে এগোচ্ছে অত্যন্ত ধীরগতিতে। ৩০-৩৫টি গাড়িতে গ্যাস ভরতে না ভরতেই সেখানে ৪০ থেকে ৫০টি গাড়ি এসে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। দীর্ঘলাইন দেখে অনেক সিএনজি অটোরিকশা ও প্রাইভেটকার চালক এক ফিলিং স্টেশন থেকে অন্য ফিলিং স্টেশনে চলে যাচ্ছে। তবে সেখানেও একই চিত্র দেখে তারা হতাশ হয়ে পড়ছে। উত্তর বাড্ডার এসটি পাওয়ার লিমিটেড নামের রিফুয়েলিং স্টেশনে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গ্যাসের জন্য অপেক্ষমাণ গাড়ির দীর্ঘলাইন স্টেশন থেকে শাহাজাদপুরের সুবাস্তু টাওয়ার পর্যন্ত পৌঁছেছে। এতে কুড়িল বিশ্বরোড-রামপুরা রোডের শাহজাদপুর অংশের একাংশ দখল হয়ে আছে। ফলে রাস্তায় যান চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে, দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।