একুশে ফেব্রম্নয়ারি যত ঘনিয়ে আসছিল, পূর্ব বাংলায় আন্দোলন তত জোরালো হচ্ছিল। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পূর্ববাংলা হয়ে উঠেছিল রীতিমতো অগ্নিগর্ভ। মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ রোপিত হয়েছিল ওই সময়েই। আন্দোলন রীতিমতো জাতীয় মুক্তিতে রূপ লাভ করে। ১৯৫২ সালের এ সময়টিতে পূর্ব পাকিস্তান রীতিমতো সাম্রাজ্যবাদী স্বৈরশাসকবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পুরোপুরি উত্তাল থেকে উত্তাল হয়ে ওঠতে থাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান।
বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের দাবিতে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রম্নয়ারি সারা দেশে ধর্মঘটের ঘোষণায় মুসলিম লীগ সরকার রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের ওপর দমন পীড়ন চালায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের চিকিৎসা না করে তাকে ঢাকা জেলে পাঠানো হয়। শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রম্নয়ারি তার পিতার কাছে জেল থেকে একটি চিরকুট পাঠান। তাতে লিখেন 'হার্টের চিকিৎসা কিছুই হয় নাই। ভয়ের কোনো কারণ নেই। খোদার রহমতে আমি মরব না। হার্ট চিকিৎসা না করেই পাঠিয়ে দিয়েছে। কারণ সদাশয় সরকার বাহাদুরের নাকি যথেষ্ট টাকা খরচ হয় আমার জন্য। এদের কাছে বিচার চাওয়া আর সাপের দাঁতের কাছে মধু আশা করা একই কথা।'
কারাবন্দি শেখ মুজিব এবং মহিউদ্দিন আহমেদ ১৯৫২ সালের ৯ ফেব্রম্নয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বরাবরে তাদের আটকাদেশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার না করা হলে ১৬ তারিখ থেকে অনশন ধর্মঘট করার হুমকি দিয়ে একটি স্মারকলিপি পাঠান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তাদের ঢাকা জেল থেকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দেয়। 'শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদের অনশন ধর্মঘট' শিরোনামে প্রচারপত্র বিলি করা হয় সারা দেশে। প্রচারপত্রে লেখা ছিল, শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদের অনশন ধর্মঘট:বিভিন্ন সংবাদপত্র ও নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাত দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছিল যে, বন্দি শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দিন আহমেদ গত ১৬ ফেব্রম্নয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করেছেন।
১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশন হলে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক (পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু, মুক্তিকামী মানুষের নেতা ও বাঙালি জাতির পিতা) শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, 'মুসলিম লীগ, লীগ সরকার, আর মর্নিং নিউজ ছাড়া প্রত্যেকেই বাংলা ভাষা চায়।' রাষ্ট্রভাষা কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ মর্নিং নিউজকে বাংলা ভাষাবিরোধী পক্ষ হিসেবে বর্জনের জন্য জনগণকে আহ্বান জানায়।
এক সময় 'সৈনিক' নামের পত্রিকাটি ছিল ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র। এছাড়া কোনো কোনো পত্রিকা সক্রিয়ভাবে আন্দোলন করেছে। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ তমদ্দুন মজলিসের উদ্যোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল মিলনায়তনে 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়েছিল তাতে 'ইনসাফ', 'জিন্দেগী', 'দেশের দাবি' পত্রিকা থেকেও একজন করে প্রতিনিধি নেওয়া হয়েছিল।
এদিকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে বাড়তি রসদ হিসেবে কাজ করে পূর্ববাংলা থেকে প্রকাশিত বেশ কয়েকটি সংবাদপত্র। সংবাদপত্রে ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক সভা-সমাবেশের খবর, বিবৃতি ফলাও করে বড় বড় হরফে প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হতে থাকে। এতে ভাষা আন্দোলন বাড়তি গতি পায়। আন্দোলন আরও বেগবান করতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে সংবাদপত্র।
ওই সময় আবুল মনসুর আহমদ ও অলি আহাদ সম্পাদিত 'দৈনিক ইত্তেহাদ' ভাষা আন্দোলনের পক্ষে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। দৈনিক ইত্তেহাদে ১৯৪৭ সালের ২২ ও ২৯ জুন দুই কিস্তিতে ছাপা হয় লেখক-সাংবাদিক মোহাম্মদ আবদুল হকের লেখা 'বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব'। ৩০ জুন দৈনিক আজাদ পত্রিকায় তিনি লিখেন 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' নামের আরেকটি প্রবন্ধ। 'উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে' নামে এই বিষয়ে আবদুল হকের লেখা তৃতীয় প্রবন্ধটি ছাপা হয় ১৯৪৭ সালের ২৭ জুলাই দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায়। সাপ্তাহিক বেগম পত্রিকায় ১৯৪৭ সালের ৩ আগস্ট চতুর্থ প্রবন্ধটি লিখেন 'মিসেস এম হক' ছদ্মনামে।
তবে মাওলানা আকরম খাঁ সম্পাদিত 'দৈনিক আজাদ' এর ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এছাড়া ইংরেজি দৈনিক 'মর্নিং নিউজ' এর ভূমিকা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। সিলেটের 'আসাম হেরাল্ড' এর ভূমিকাও ছিল একই রকম। অন্যদিকে বাংলা ভাষার পক্ষ না নেওয়া পত্রিকাগুলোর প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায় সিলেটের সাপ্তাহিক 'নও-বেলাল'। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন প্রগতিশীল যুব নেতা মাহমুদ আলী। ভাষা আন্দোলনের সমর্থন করেছে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত 'মাসিক সীমান্ত' পত্রিকা। পত্রিকাটির সম্পাদক মাহবুব আলম চৌধুরীই প্রথম ভাষাশহীদদের নিয়ে কবিতা লিখেন, 'কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি'। ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে প্রকাশিত মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সাপ্তাহিক 'ইত্তেফাক' এর ভূমিকাও ছিল উলেস্নখযোগ্য। ভাষা আন্দোলনের ক্ষেত্রে ব্যক্তি ভাসানীর ভূমিকা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
ভাষা আন্দোলনে মর্নিং নিউজ পত্রিকার ভূমিকা প্রসঙ্গে আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক 'ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য' গ্রন্থে বলেছেন, অবাঙালি স্বার্থের প্রতিনিধি এবং মূলত পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শ্রেণি স্বার্থের প্রতিনিধি 'মর্নিং নিউজ'। পত্রিকাটি ভাষা আন্দোলনের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এবং তার চরিত্রহননের জন্য যত ধরনের সম্ভব মিথ্যা, মনগড়া সংবাদ পরিবেশ করেছিল। জঘন্য কুৎসামূলক সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখে বাংলা ও বাঙালি জাতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেই কর্তব্য শেষ করেনি, সাম্প্রদায়িকতার উদ্দেশ্যমূলক উসকানিও দিয়েছে।
তথ্য সূত্র : আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ঢাকা, ১৯৭৫ইং; আবদুল হক, ভাষা-আন্দোলনের আদি পর্ব, ঢাকা, ১৯৭৬ইং। বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, ১ম খন্ড, ঢাকা, ১৯৭৯ ইং।