বেসরকারি চিকিৎসায় অনিয়মের ফাঁদ!
প্রকাশ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
সাখাওয়াত হোসেন
লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল এবং যেগুলোর অবকাঠামো নেই ওইসব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হবে। স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে থাকবে জিরো টলারেন্স। কেউ অনিয়ম করলে সে যেই হোক তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দায়িত্ব নিয়ে সচিবালয়ে প্রথম কার্যদিবসেই এ হুঁশিয়ারি জানান নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তবে এরপর মাস ঘুরলেও লাইসেন্সবিহীন হাসপাতালের বিরুদ্ধে গতানুগতিক অভিযানের বাইরে বেসরকারি চিকিৎসার পদে পদে অনিয়মের ফাঁদ ভাঙতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে লাইসেন্স পাওয়া বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনেস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলোতে সুনির্ধারিত ভৌত সুবিধা, সার্বক্ষণিক চিকিৎসক, ডিপেস্নামাধারী নার্স ও ওয়ার্ডবয়সহ প্রয়োজনীয় জনবল এবং যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ আছে কিনা এসব যাচাইয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ এখনো চোখে পড়েনি। চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য অত্যাবশকীয় ফায়ার সার্ভিসের লাইসেন্স, ফার্মেসি পরিচালনার জন্য লাইসেন্স, পরিবেশ লাইসেন্স, পরমাণুবিক শক্তি কমিশন লাইসেন্স, মেডিকেল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট লাইসেন্স, নারকোটিকস লাইসেন্স ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের এনওসি পর্যবেক্ষণে কোনো টিম এখনো মাঠে নামেনি।
এছাড়া দালালের মাধ্যমে সরকারি হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে এনে নির্বিচারে কমিশন ও টেস্ট বাণিজ্য বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সার্টিফিকেটবিহীন অদক্ষ টেকনিশিয়ান দিয়ে রোগ নির্ণয় করে সাধারণ রোগীদের ভুল চিকিৎসার মুখে ঠেলে দেওয়া; আইসিইউ, ভেন্টিলেশন সাপোর্ট ও সেন্ট্রাল অক্সিজেনের নামে ছলচাতুরি ও রোগীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ফি আদায় করাসহ নানাভাবে হয়রানি বন্ধেও নেই কোনো অভিযানিক তৎপরতা। যদিও এরই মধ্যে মেডিকেল লাইসেন্সবিহীন ও যথাসময়ে লাইসেন্স নবায়ন না করা ৭ শতাধিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তবে শুধু অভিযান চালিয়ে লাইসেন্সবিহীন ও যথাসময়ে লাইসেন্স নবায়ন না করা বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক-ডায়াগনেস্টিক সেন্টার বন্ধ করা হলেই এ খাতের চিকিৎসা ব্যবস্থার অনিয়ম দুর্নীতি আদৌ বন্ধ করা যাবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। এতে উল্টো বেসরকারি চিকিৎসা খাতে অপচিকিৎসা ও অব্যবস্থাপনা আরও বাড়বে এবং একশ্রেণির অতিলোভী মানুষ টাকা খরচ করে লাইসেন্স বাগিয়ে নিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো আরও হাজার হাজার মানহীন নতুন চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে বলে মনে করেন তারা।
এদিকে নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী সামান্ত লাল সেন স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জিরো টলারেন্সের কথা বললেও খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতনদের খামখেয়ালিপনা ও কর্তব্য অবহেলার লাগাম টেনে ধরতে পারেননি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, ১১ ফেব্রম্নয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের (স্বাস্থ্যসেবা) পক্ষে হাইকোর্টে অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বস্নাড ব্যাংকের যে হিসাব দেওয়া হয়েছে তার পুরোটাই শুভঙ্করের ফাঁকি। এ সংখ্যা ১ হাজার ২৭টি বলা হলেও বাস্তবে তা কয়েক গুণ বেশি। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের নাম-ঠিকানা হাইকোর্টকে জানানো হলেও এগুলো কেন এতদিন বন্ধ করা হয়নি তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর উচ্চ আদালতে যে তালিকা দিয়েছে, বাস্তবে এই সংখ্যা আরও অনেক বেশি। জনবল বা তথ্য ঘাটতির কারণে হয়ত তাদের রিপোর্টে বাস্তব চিত্রটা উঠে আসেনি। তারপরও সংখ্যাটা যাই হোক না কেন, অনুমোদন ছাড়া এসব প্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ করে দেওয়া হয়নি তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
এদিকে এ তালিকা যে পূর্ণাঙ্গ নয়, তা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান নিজেই তা পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, 'আমরা উচ্চ আদালতে যে তালিকা দিয়েছি, সেটা কম বেশি হতে পারে। আমরা সব জেলার সিভিল সার্জনের কাছে অবৈধ বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও বস্নাড ব্যাংকের তালিকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলাম। তারা অনুসন্ধান করে যে তালিকা দিয়েছে, আমরা সেটাই উচ্চ আদালতে জমা দিয়েছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অপর এক কর্মকর্তা বলেন, দেশের আনাচে-কানাচে গজিয়ে উঠেছে হাজার হাজার অনিবন্ধিত ক্লিনিক-হাসপাতাল। ফলে অধিকাংশ হাসপাতালে প্রতিদিনই ঘটছে নানা অঘটন। ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে রোগীদের মৃতু্য পর্যন্ত ঘটছে। তবে সব প্রতিষ্ঠানের তথ্যও নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। দেশজুড়ে এমন অবৈধ, নিবন্ধনহীন হাসপাতালের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। যেগুলোর বেশির ভাগেরই নাম ও অবস্থান জানে না অধিদপ্তর। অনলাইনে আবেদনের পর স্বাস্থ্য বিভাগের একটি টোকেন, সিটি করপোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা করছেন ক্লিনিক মালিকেরা। এসব অবৈধ, নিবন্ধনহীন ক্লিনিক-হাসপাতাল বন্ধে নানা সময়ে অভিযান পরিচালিত হলেও আসলে কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। বরং এই সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এভাবে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। শুধু অভিযান চালিয়ে চলে গেলে হবে না। লাগাতার পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এই দুর্বলতা শুরু থেকেই রয়েছে। আসলে প্রয়োজন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে একটা আলাদা উইং তৈরি করা। তাদের পর্যাপ্ত জনবল ও সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। তারা সারা বছরই এগুলো মনিটরিং করবে। এর পাশাপাশি মফস্বলে স্থানীয় প্রশাসনকেও এর সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। আর বন্ধ করাও কোন সমাধান না। যেগুলো তৈরি হয়েছে, সেগুলো কীভাবে সঠিকপথে আনা যায় সেই চেষ্টাও করতে হবে। তাহলেই স্বাস্থ্য খাত সুশৃঙ্খল হয়ে গড়ে উঠবে।
জাতীয় স্বাস্থ্য আন্দোলনের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ ই মাহাবুব বলেন, এসব অভিযান চালানো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এসব করতে গেলে তাদের মূল কাজ বিঘ্নিত হবে। জেলায় জেলায় কর্তৃপক্ষ গড়ে তোলার তাগিদ দিয়ে এই স্বাস্থ্য অধিকারকর্মী বলেন, একটি অধিদপ্তর বা পরিদপ্তর গঠন করে তার অধীনে এসব কাজ করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নাজমুল হোসাইন বলেন, এসব অভিযান কিছু দিন পরপরই হয় কিন্তু তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। বন্ধ হয়ে যাওয়া কোনো প্রতিষ্ঠান যেন আবারও অবৈধভাবে কার্যক্রম চালাতে না পারে, সে জন্য বছরজুড়ে তদারকি প্রয়োজন।
আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খান মনে করেন, চিকিৎসার বেলায় অব্যবস্থাপনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব অবৈধ ক্লিনিক আছে, তাদের যে মান থাকা উচিত, তা নেই। সেখানে কোনো চিকিৎসক নেই, কোনো ধরনের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয় না। ল্যাবে যেসব যন্ত্রপাতি আছে, সেগুলোও মানহীন। রোগীরা প্রতারিত হবেন বা সঠিক চিকিৎসা পাবেন না, এ রকম ক্লিনিক বা হাসপাতাল দরকার নেই। এসব বন্ধে সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। অভিযান পরিচালনা করবে এটি অবশ্যই ভালো উদ্যোগ। তবে কাঙ্ক্ষিত ফল পেতে দীর্ঘস্থায়ী পদক্ষেপ দরকার। এটা যেন থেমে না যায়। এজন্য সার্বক্ষণিকভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানসম্মত করার কাজটি কখনই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ধারাবাহিকভাবে করেনি। এর আগে অনেকবার উদ্যোগ নিলেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানে মানহীন চিকিৎসার কারণে মানুষের জীবন ঝুঁকিতে পড়ছে। স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে শুধু অভিযান চালিয়ে অবৈধ হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো বন্ধ করলে সমস্যার সমাধান হবে না। বেসরকারি খাতে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে নিরবচ্ছিন্ন তদারকি প্রয়োজন। এটি বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ও সংঘবদ্ধ প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে।
স্বাস্থ্য অদিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী, ১০ বেডের একটি ক্লিনিকের অনুমোদনের ক্ষেত্রে শুধু রোগীর ওয়ার্ডের জন্য প্রতি বেডে ৮০ বর্গফুট করে মোট ৮০০ বর্গফুট জায়গা লাগবে। সেই সঙ্গে ওটিরুম, পোস্ট ওপারেটিভ রুম, ওয়াস রুম, যন্ত্রপাতি কক্ষ, লেবার রুম, ডক্টরস ডিউটি রুম, নার্সেস ডিউটি রুম, অপেক্ষমাণ কক্ষ, অভ্যর্থনা কক্ষ, অফিস কক্ষ, চেইনঞ্জিং রুম, স্টেরিলাইজার রুম ও ভান্ডার রুমসহ সামঞ্জস্যপূর্ণ অনন্ত ১৩টি রুম থাকতে হবে।
এছাড়া পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা প্রয়োজনীয় সংখ্যক টয়লেট, প্রসস্থ সিঁড়ি, জেনারেটরসহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে (বিল্ডিং তিনতলার অধিক হলে) লিফটের ব্যবস্থা থাকতে হবে। অপারেশন (ওটি) রুমে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা, ওটি টেবিল, পর্যাপ্ত ওটি লাইট, সাকার মেশিন, অ্যানেসথেসিয়া মেশিন, ডায়াথারমি মেশিন, জরুরি ওষুধের ট্রে, রানিং ওয়াটার, অক্সিজেন, আইপিএসের ব্যবস্থা থাকতে হবে। সাধারণ বর্জ্য, ধারালো বর্জ্য, জীবাণুযুক্ত বর্জ্য, তরল বর্জ্যসহ সব ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও থাকা অত্যাবশ্যকীয়। জনবল কাঠামোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, তিনজন ডিউটি ডাক্তার, ছয়জন ডিপেস্নামা নার্স, প্রয়োজনীয় অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারী, ওয়ার্ডবয়, আয়া, ক্লিনার থাকতে হবে।
অথচ সরেজমিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার প্রায় এক ডজন বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক ঘুরে দেখা গেছে, এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগেরই প্রয়োজনীয় ভৌত (কক্ষ) সুবিধা নেই। নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। নেই ডিউটি ডাক্তার, ডিপেস্নামা নার্স, টেকনিশিয়ান, কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ প্রয়োজনীয় জনবল। অথচ এসব নিয়ম-নীতির কোন তোয়াক্কা না করে সিভিল সার্জন অফিসের এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশে ও স্বাস্থ্য বিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদতে বিপুল পরিমাণের অর্থের বিনিময়ে চিকিৎসা বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে।