ফলের বাজারেও সিন্ডিকেট
প্রকাশ | ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাসুম পারভেজ, কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
রাজধানী ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা। প্রাচীনকাল থেকেই সাহিত্যের চেয়ে বাণিজ্য চর্চাই হয়েছে বেশি। এখন পর্যন্ত এর আশপাশের এলাকা ব্যবসা-বাণিজ্যে 'আঁতুড়ঘর'। তেমনই এই নদীকে কেন্দ্র করে গত ৮৯ বছর ধরে গড়ে উঠেছে দেশি-বিদেশি ফলের সবচেয়ে বড় বাজার বাদামতলী। এখান থেকেই পণ্য কিনে সরবরাহ করা হয় সারাদেশে। তাইতো ক্রেতা-বিক্রেতার হাঁকডাকে সরগরম থাকে সবসময়।
আম, কাঁঠাল, আপেল, মাল্টা থেকে শুরু করে আনার, নাশপাতি, কমলা, আঙুর, তরমুজ, পেয়ারা, খেজুর, বরই, লিচু, আনারস, পেয়ারা, নারকেল, কিসমিসসহ সব রকমের দেশি-বিদেশি ফলের সমাহার রয়েছে দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারি এই ফলের আড়তে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বিশেষ করে সৌদি আরব ও মিশরের খেজুর, চীনের আপেল, কমলা এবং ইরাক, তুরস্ক, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফল আমদানি করে থাকেন বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টস অ্যাসোসিয়েশন। এছাড়া বিভিন্ন মৌসুমি ফলও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এনে থাকেন এখানকার আড়তদাররা। যার বর্তমানে ডলার সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি এবং আমদানিতে অতিরিক্ত শুল্কারোপের কারণে ফল ও খেজুরের দাম এমনিতেই সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এর মধ্যে এক শ্রেণির আমদানিকারক, কমিশন এজেন্টরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তাদের যুক্তি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, এলসি খোলার জটিলতা এবং পরিবহণ ব্যয় গত বছরের তুলনায় বেশি। কিন্তু অনেক আমদানিকারক উচ্চমূল্যের খেজুর শুল্ক ফাঁকি দিতে কম দাম দেখিয়ে আমদানি করেছে। বাজারে বিক্রি করছে চার থেকে পাঁচগুণ দামে। তারা জানান, দেশে হাতে গোনা ৪০০ জন আমদানিকারক ফল আমদানি করেন। এর মধ্যে খেজুর আনেন ১০০ জন। আর এ গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে ক্রেতারা জিম্মি। তারা চিহ্নিত; কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। এতে পরিবারের জন্য যারা নিয়মিত ফল কিনতেন, তারা বাজারের তালিকা থেকে পুষ্টিকর এ পণ্যটি বাদ দিচ্ছেন।
রাজধানীর সর্ববৃহৎ ফলের পাইকারি আড়ত সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, সদরঘাটের উত্তর দিকে বাকল্যান্ড বাঁধের পাশ ধরে ওয়াইজঘাট থেকে বাদামতলী ঘাট পর্যন্ত দুই কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে রয়েছে হরেক-রকমের পাইকারি ফলের আড়ত ও খুচরা ফলের দোকান। বাদামতলী ও ওয়াইজঘাট এলাকার বিভিন্ন ভবনে ৪শ-৫শ'টি ফলের আড়ত রয়েছে। এছাড়া বুড়িগঙ্গা পাড়ে রাস্তার দু'পাশে বিনাস্মৃতি স্নান ঘাট থেকে বাদামতলী ঘাটের শেষ মাথা পর্যন্ত ৩শ'টিরও বেশি খুচরা ফলের দোকান রয়েছে। প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু করে বেলা ১টা পর্যন্ত ১৫০-২০০টি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানে ফল নিয়ে ব্যবসায়ীরা এখানে জড়ো হন। এছাড়া ঢাকা ও আশপাশের এলাকাগুলো থেকে খুচরা বিক্রেতারাও এসে ভিড় জমান এখানে। এখানকার আড়তগুলোতে এক ক্যারেটের (২০ কেজি) নিচে ফল বিক্রি করা হয় না। অভ্যন্তরীণ এবং আমদানি করা ফলের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যবসাই ব্যস্ততম এই পাইকারি বাজারকেন্দ্রিক। দিনে প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ কোটি টাকার ফল বেচাকেনার এই বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট। নিজেদের মনমতো ফলের দাম নির্ধারণ, ফলের কার্টনে ওজন কম দেওয়া, সাধারণ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়সহ নানাভাবে ফায়দা লুটছেন তারা। দেশের বৃহৎ এই ফলের বাজারকে এভাবে অস্থিতিশীল করে রাখায় বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, গত অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ডলার সংকটে খেজুরের এলসি খোলা আগে কমলেও এখন বাড়ছে। এছাড়া সার্বিকভাবে ফলের এলসি খোলা বেড়েছে ২৯ দশমিক ২০ শতাংশ। তবে আগে এলসি খোলা কমায় এখন আমদানি কমেছে ৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, রোজা উপলক্ষে এবার ফল ও খেজুরের পর্যাপ্ত এলসি খোলা হয়েছে। সেসব পণ্য দেশে আসতেও শুরু করেছে। আমদানি করা মোট খেজুরের ৯৫ শতাংশের বেশি আসে ইরাক, দুবাই, তিউনেশিয়া ও আলজেরিয়া থেকে। আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নভেম্বর খেজুরের মৌসুম। খেজুর উৎপাদনকারী দেশগুলোতে এবারের মৌসুম প্রায় শেষের পথে। তবে আমদানি শুল্ক বৃদ্ধির কারণে এ বছর দেশের ছোট ব্যবসায়ীরা এখনো খেজুর কিনতে পারেননি। রমজানের কাছাকাছি সময়ে বর্ধিত শুল্ক কমানো হলেও তখন এলসি করতে হলে বেশি দামে কিনতে হবে। আবার সময় স্বল্পতার কারণে তখন খেজুর ভোক্তাদের হাতে পৌঁছানো কঠিন হবে।
ব্যবসায়ী নাজিম উদ্দীন লালু বলেন, ডলার সংকটের কারণে গত প্রায় ৮ মাস ধরে নিয়মিত ফল আমদানিকারকদের বেশিরভাগ এলসি খোলার সুযোগ পাননি। কিন্তু মুষ্টিমেয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ব্যাংকের মাধ্যমে এলসি খুলে বিদেশি ফল আমদানি করেছে। আমদানি করা এসব ফল মজুত রেখে চাহিদার তুলনায় কম পরিমাণে বাজারে সরবরাহ করছেন। ক্রাউন আপেল ১৮ কেজির বাক্স বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৮শ' টাকা, যা গত বছর একই সময় দাম ছিল ৩ হাজার ৯শ' থেকে ৪ হাজার টাকা। পাইকারি আড়তে ১৮ কেজির বাক্সে মাল্টা মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ২ হাজার ৯শ' থেকে ৩ হাজার ১শ' টাকা, যা গত বছর একই সময় ২ হাজার ৩৫০ থেকে ২ হাজার ৬শ' টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাইকারি আড়তে ১৮ কেজি ওজনের বাক্সে চায়না কমলা বিক্রি হচ্ছে ৩ হাজার ৩শ' টাকা, যা আগে ২ হাজার ৬শ' থেকে ২ হাজার ৭শ' টাকা ছিল। পাশাপাশি খেজুরের আড়তে পাঁচ কেজি প্যাকেটের মরিয়ম প্রিমিয়াম খেজুর বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫শ' টাকা, যা গত বছর একই সময় বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৫শ' টাকা। মাবরুর খেজুর প্রতি প্যাকেটে বিক্রি হচ্ছে ৬ হাজার টাকা, যা আগে ৩ হাজার ৪শ' থেকে ৩ হাজার ৬শ' টাকায় বিক্রি হয়েছে। বড় আকারের ম্যাডজুল খেজুরের পাঁচ কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার ৫শ' টাকা, যা আগে ৬ হাজার টাকা ছিল। ছয় কেজি ওজনের আজোয়া খেজুরের প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৭ হাজার টাকা, যা গত বছর একই সময় ৬ হাজার ২শ' টাকা ছিল। দাবাস ক্রাউন খেজুরের পাঁচ কেজির প্যাকেট বিক্রি হচ্ছে ৪ হাজার ৫শ' টাকা, যা গত বছর একই সময় ৩ হাজার ৪শ' টাকা ছিল।
জননী ফলের আড়তের স্বত্বাধিকারী জালাল উদ্দিন বলেন, আমরা আমদানিকারকদের কাছ থেকে যে দরে ফল আনি, পরে কিছু কমিশনে বিক্রি করে দিই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, রোজা উপলক্ষে এবার আমদানিকারকরা দাম বাড়িয়েছে। যে কারণে পাইকারি পর্যায়ে দাম বাড়তে শুরু করেছে। আরেক ব্যবসায়ী জব্বার আলী জানান, বাদামতলী ফলের বাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে একটি সিন্ডিকেট। ফলের দাম ওঠানামার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে। বর্তমানে ডলার সংকট এবং বৈশ্বিক সমস্যা দেখিয়ে এই সিন্ডিকেট ফলের দাম বাড়িয়েছে। বাদামতলীতে প্রতিদিন প্রায় ১৮০ থেকে ২শ'টি ট্রাক ও পিকআপ ভর্তি আমদানি করা ফল আসে।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দীন আহমেদ বলেন, দেশে প্রতিদিন ফলের চাহিদা ১০ থেকে ১২ হাজার টন। সারা বছর ধরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ফল আমদানি হয়। সরকার এতে রাজস্ব পায় ৩ হাজার কোটি টাকা। ফল আমদানি কমে যাওয়ায় সরকার বাড়তি শুল্ক আরোপ করে কম রাজস্ব পাবে। অন্যদিকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত ভোক্তাকে আরও বেশি দামে বিদেশি ফল খেতে হবে। ইমপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাথী ফ্রুটসের মালিক সিরাজুল ইসলাম বলেন, "আমরা কোনো কারসাজির সঙ্গে জড়িত নই। সবাই প্রকৃত ফল ব্যবসায়ী। বিদেশি ফলকে 'বিলাসপণ্য' দেখিয়ে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করায় সব ফলের দাম বেড়েছে ৪০ শতাংশের বেশি। উচ্চহারে শুল্কায়ন মূল্য নির্ধারণ করায় বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচার হওয়ার আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে।" তিনি আরও বলেন, কাস্টমসে মালপত্র খালাস করতে ঘুষ নেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাড়ছে পরিবহণ খরচ। কোনো খরচই কমে না; কিন্তু ফলের দাম বাড়লে দোষ হয় আমাদের। খেজুরের শুল্ক বৃদ্ধি পাওয়ায় কেউ এখনো খেজুর কিনেননি। এ কারণে রোজায় ফ্রেস খেজুর পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তাছাড়া সব ফলেরই দাম বাড়বে। তবে টাকা পাচার করে যারা অবৈধভাবে ফল আমদানি করছেন আমরা চাই তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করুক সরকার।
এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বিদেশি ফলকে 'বিলাসপণ্য' দেখিয়ে আমদানিতে এলসি মার্জিন ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। এতে গত বছর রোজা থেকে ফলের দাম বাড়তি। এখন ডলারের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ফলের দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে এর মধ্যে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়ালে ক্রেতা ভোগান্তিতে পড়বে। তাই তদারকির মাধ্যমে শিগগিরই ব্যবস্থা নিতে হবে। তা না হলে ভোগান্তি আরও বাড়বে।