সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালু
শুষ্ক মৌসুম ঘিরে নড়েচড়ে বসেছে ফায়ার সার্ভিস
প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
গাফফার খান চৌধুরী
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে অগ্নিকান্ডের ঘটনা বৃদ্ধির আশঙ্কায় কেমিক্যালের অবৈধ গুদামের বিরুদ্ধে অভিযানে নামছে ফায়ার সার্ভিস। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি নিজেদের সতর্কতা বাড়ানোর পাশাপাশি জনগণকে অগ্নিকান্ড সম্পর্কে আরও সচেতন করার উদ্যোগ নিয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও এরই মধ্যে ফায়ার সার্ভিসকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সারা বছরই অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। তুলনামূলকভাবে বেশি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে শুষ্ক মৌসুমে। এ সময় বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ কম থাকায় নির্মাণসামগ্রী একেবারে শুকিয়ে বারুদের মতো হয়ে থাকে। এর মধ্যে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে, তা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গত বছর জানুয়ারিতে আড়াই হাজারের বেশি, ফেব্রম্নয়ারিতে প্রায় তিন হাজার, মার্চে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার ও এপ্রিলে তিন হাজারের বেশি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। জলবায়ু সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো চলতি বছর গরমের তীব্রতা বৃদ্ধির আভাস দিয়েছে। ফলে অগ্নিকান্ডের সংখ্যা এ বছর বাড়তে পারে এমন ধারণা করছে সংশ্লিষ্টরা।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মিডিয়া কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার যায়যায়দিনকে বলেন, ২০২৩ সালে সারাদেশে সাড়ে ২৭ হাজারেরও বেশি অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। অগ্নিকান্ডে নিহত হয়েছেন ১০২ জন। আহত হয়েছেন ২৮১ জন। একে প্রায় ৮শ' কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতি হয়েছে। অধিকাংশ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে বৈদু্যতিক শর্ট সার্কিট, বিড়ি সিগারেটের আগুন, গ্যাস ও লাকড়ির চুলা এবং গ্যাসের চুলা থেকে। বাসাবাড়ি ও আবাসিক ভবনে সবচেয়ে বেশি অগ্নিকান্ড ঘটেছে। সবচেয়ে কম অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে। অন্যান্য মাসগুলোতে অগ্নিকান্ডের ঘটনা তুলনামূলকভাবে বেশি ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, বৈদু্যতিক সরঞ্জাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে
মানুষকে আরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। যেমন ইলেকট্রিক টোস্টার, ওভেন, হেয়ার ড্রায়ার, ইলেক্ট্রিক কেটলি, পানি গরম করার হিটার, ফ্রিজ, এসিসহ অন্যান্য জিনিসপত্র ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গরম শুরু হলে চালু করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ঘর থেকে ইঁদুর তাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ ইঁদুরে বৈদু্যতিক তার কেটে ফেললে বড় ধরনের অগ্নিকান্ড ঘটনার সম্ভাবনা থাকে। নিয়মিত এক্সস্ট ফ্যান পরিষ্কার রাখা। কারণ এসব ফ্যানে লেগে থাকা ময়লায় হিট থেকে আগুন লেগে বড় ধরনের অগ্নিদুর্ঘটনার সৃষ্টি করতে পারে। রান্না ঘরের চুলার ওপরে থাকা হুডার নিয়মিত পরিষ্কার রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ হুডারে ময়লা জমে তাতে আগুন ধরে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অন্তত এক মাস পর পর হুডার পরিষ্কার করতে হয়।
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন যায়যায়দিনকে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে চলতি বছর অগ্নিকান্ডের ঘটনা আরও বেশি ঘটার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য ফায়ার সার্ভিসের প্রত্যেক সদস্য ও প্রতিটি স্টেশনকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকেও এমন নির্দেশনা এসেছে।
তিনি আরও বলেন, চলতি বছর অগ্নিকান্ডের ঘটনা যাতে কম ঘটে, এজন্য জনগণকে আগাম সতর্ক করা হচ্ছে। জনসচেতনামূলক নানা কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। বিশেষ করে প্রতিটি বাণিজ্যিক, আবাসিক ভবনে ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশিকা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বহুতল ভবনে থাকা হাইড্রেন্ডে পর্যাপ্ত পানির মজুত রাখতে বলা হয়েছে ভবন মালিকদের। বাসাবাড়ি ও ভবনে থাকা আগুন নিভানোর সরঞ্জাম সচল রাখতে বলা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, অগ্নিদুর্ঘটনারস্থলে উৎসুক জনতার ভিড় সামলাতে গঠিত ক্রাউড কন্ট্রোল পার্টির সদস্য সংখ্যা আরও বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া ঢাকায় বেআইনি কেমিক্যালের গুদামের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে। কারণ কেমিক্যালের আগুন যেমন ভয়াবহ হয়, তেমনি প্রাণহানি ও ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি হয়। এজন্য কোনোভাবেই বেআইনি কেমিক্যালের গুদাম আবাসিক এলাকা রাখতে দেওয়া হবে না।
বিস্ফোরণ ও বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকান্ড সম্পর্কে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডক্টর মাকসুদ হেলালী যায়যায়দিনকে বলেন, প্রায় শতভাগ দুর্ঘটনার জন্যই দায়ী ব্যক্তিগত অসচেতনতা ও যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাব। রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়া তিতাস গ্যাসের লাইন নিয়মিত মনিটরিং করা প্রয়োজন। না হলে প্রায়ই গ্যাস লাইনের লিকেজ থেকে বড় বড় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। অতীতে যার অনেক নজির আছে। ঢাকার অধিকাংশ ভবনের আন্ডারগ্রাউন্ডে অর্থাৎ মাটির নিচে সেপটিক ট্যাংক রাখা হয়। এসব ট্যাংকে জমে থাকা মিথেন গ্যাস থেকে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটে। নিয়মিত এসব ট্যাংক নিয়মানুযায়ী পরিষ্কার করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সেপটিক ট্যাংক পরিষ্কারের সময় ট্যাংকের ভেতরে শক্তিশালী টেবিল ফ্যান দিয়ে বাতাস দিতে হয়। যাতে করে ভেতরে জমে থাকা মিথেন গ্যাস বেরিয়ে যায়। এতে করে আর কোনো দুর্ঘটনা ঘটার ভয় থাকে না। নিয়মিত সু্যয়ারেজ লাইনের রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। অর্থাৎ লাইন রাখতে হবে। লাইনে ময়লা জমে গেলে তা পরিষ্কার করে দিতে হবে। অন্যথায় গ্যাস জমে বড় ধরনের বিস্ফোরণ হবে। ঘটবে অগ্নিকান্ডের ঘটনা। গ্যাসের চুলা সঠিক মিস্ত্রি দিয়ে ঠিক করতে হবে। কারণ পাড়া মহলস্নায় যারা মাইক দিয়ে ডেকে ডেকে গ্যাস চুলা ঠিক করেন, তাদের গ্যাসের চুলা সম্পর্কে তেমন কোনো ধারণাই নেই। যে কারণে প্রায়ই গ্যাসের চুলা থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে।
এই বিশেষজ্ঞ আরও জানান, এসি মেরামতের সঙ্গে জড়িতদের অধিকাংশই যন্ত্রটি সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। ২০১৫ সাল পর্যন্ত এসিতে আগুন লাগার কোনো রেকর্ড পাওয়া যায় না। এরপর বাজারে আসা প্রায় সব ধরনের এসির বিস্ফোরণের রেকর্ড আছে। দেশীয় কারিগররা এসিতে আইসোবিউটেট নামের গ্যাস ব্যবহার করেন। এটি খুবই উচ্চমাত্রার দাহ্য ও বিস্ফোরক জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ। এই গ্যাস এসির কম্প্রেসারে ব্যবহার করলে বিস্ফোরণে অগ্নিকান্ডের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি।
তিনি বলেন, সিএফসি (ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন) ও এইচএফসি (হাইড্রো ফ্লোরো কার্বন) কার্বন ব্যবহৃত এসির বিস্ফোরণের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এসিতে আগুন লাগলেও বিস্ফোরণ ঘটবে না। এই দুই ধরনের রাসায়নিক পদার্থই বাজারে সহজলভ্য। রাসায়নিক পদার্থ দুটি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশে এসব রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহার আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে বাংলাদেশে বন্ধ হয়নি। এছাড়া এইচসিএফসি (হাইড্রো ক্লোরো ফ্লোরো কার্বন) বাজারে রয়েছে। এই গ্যাস অন্যান্য গ্যাসের তুলনায় তুলনামূলকভাবে আরও বেশি নিরাপদ। অগ্নিকান্ড কমাতে সরকারের কাছে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো শতভাগ বাস্তবায়িত হলে অগ্নিকান্ডের ঘটনা কম ঘটবে। হতাহত ছাড়াও ক্ষতি কম হবে। যা দেশ ও দেশবাসীর জন্য সুফল বয়ে আনবে।