সরস্বতী পূজা উদযাপিত সৃজনশীল ও পরিশীলিত বিদ্যা-বুদ্ধির প্রার্থনা

প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

যাযাদি ডেস্ক
সরস্বতী পূজা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি স্থাপন করে পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন পুণ্যার্থীরা। ছবিটি বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল থেকে তোলা -যাযাদি
দেবীর কাছে সৃজনশীল ও পরিশীলিত বিদ্যা-বুদ্ধির প্রার্থনা জানিয়ে, বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্যদিয়ে বুধবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী পূজা সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়েছে। পূজা উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মন্দির ও বাড়িতে দেবীর মৃন্ময়ী মূর্তি স্থাপন করে হাতেখড়ি, পুষ্পাঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ ও আরতি প্রদান করে আনন্দে মেতে ওঠেন শিক্ষার্থী ও পুণ্যার্থীরা। বিদ্যাদেবী সরস্বতীর বন্দনায় ঢাকঢোল, কাঁসর, শঙ্খ ও উলুধ্বনিতে মুখর হয়ে ওঠে মন্দির প্রাঙ্গণ। বিদ্যা ও সংগীতের দেবী সরস্বতীর কৃপা-লাভের আশায় প্রতিবছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) বিভিন্ন বিভাগ ও ইনস্টিটিউটের \হশিক্ষার্থীরা জগন্নাথ হল মাঠে আলাদা আলাদা পূজামন্ডপ তৈরি করেন। বিভিন্ন থিমের আলোকে এবারও সেখানে ৭২টি মন্ডপ তৈরি করা হয়েছে। এবারও হলের পুকুরে বসানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন সরস্বতী দেবীর প্রতিমা। এটি তৈরি করেছে চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া রোকেয়া হল, কবি সুফিয়া কামাল হল, শামসুন্নাহার হল, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, বাংলাদেশ কুয়েত-মৈত্রী হলে পূজা ও বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সবমিলিয়ে সরস্বতী পূজায় জগন্নাথ হল যেন সেজে উঠেছিল অপরূপ রূপে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, দেবী সরস্বতী সত্য, ন্যায় ও জ্ঞানালোকের প্রতীক। দেবীর একহাতে পুস্তক, আর অন্য হাতে বীণা। এজন্য তাকে 'বীণাপাণি'ও বলা হয়। তার বাহন সাদা রাজহাঁস। মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে সাদা রাজহাঁসে চেপে দেবী ধরায় আসেন। মর্ত্যলোকে ভক্তরা অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করতে কল্যাণময়ী দেবীর চরণে পূজার অর্ঘ্য নিবেদন করেন। সকাল ৯টায় জগন্নাথ হলে বাণী অর্চনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় পূজার আনুষ্ঠানিকতা। পুরোহিত 'সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমল লোচনে/বিশ্বরূপে বিশালাক্ষী বিদ্যংদেহী নমোহস্তুতে' মন্ত্রপাঠ করে দেবীর আশীর্বাদ কামনা করেন। এরপর ভক্তরা দেবীকে পুষ্পাঞ্জলি দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা পেশার মানুষ সেখানে সরস্বতীর আরাধনা করেন। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে এসেছিলেন সাবেক শিক্ষার্থীরাও। ঢাকার বনশ্রী থেকে ছেলে ঔম সরকারকে হাতেখড়ি দিতে জগন্নাথ হলে আসা বনমালি সরকার বলেন, 'আমার সন্তান যেন বিদ্যা-বুদ্ধিতে মানুষের মতো মানুষ হয়, সেই প্রার্থনা করেছি দেবী সরস্বতীর কাছে। যে জ্ঞান মানুষের কল্যাণে কাজে লাগে, দেশের জন্য কাজ করতে পারে, সেই জ্ঞানের প্রার্থনা করেছি।' মেয়ে রৌদ্দুর রায়কে জগন্নাথ হলে এনে হাতেখড়ি দেন মিরপুর থেকে আসা সত্যজিৎ রায়। তিনি বলেন, 'মা সরস্বতীর কাছে প্রার্থনা করছি, আমার মেয়ে যেন বিদ্যা-বুদ্ধিতে মানুষের মতো মানুষ হয়।' জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ও পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মিহির লাল সাহা বলেন, 'সরস্বতী পূজায় আমরা সব সময়ই বিদ্যা দেবীর কাছে বিদ্যা অর্জনের প্রার্থনা করি। সেই বিদ্যাটা হবে পরিশীলিত বিদ্যা, অসাড় বিদ্যা নয়, যেটা বিশ্বের কাজে লাগবে।' তার ভাষ্যে- 'বিশ্বে নতুন আঙ্গিকে যে ডিজিটাল ব্যবস্থা আসছে, সেই জায়গা থেকে বিদ্যাটাও যেন সেভাবে অর্জন করতে পারি। আমাদের শিক্ষার্থীদের যাতে সে রকম বিদ্যা আমাদেরকে তিনি দেন। বাংলাদেশকে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর জন্য যে জ্ঞান দরকার, সেই বিদ্যা যেন আমরা লাভ করতে পারি।' বুধবার জগন্নাথ হলের মাঠে ঢাবির বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একটি পূজা মন্ডপের চূড়ায় শিকলবদ্ধ কলম; নিচে প্রতীকী গণমাধ্যম। ওপরে লেখা 'মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র'। আবার মন্ডপের মাঝে লেখা হয়েছে 'মেধা-এমসিকিউ?', বিদ্যা দেবীর পায়ের নিচে ধুলোয় মলিন হয়ে পড়ে আছে ধ্রম্নপদী কিছু সাহিত্যের বই। দেবী সরস্বতীকে ঘিরে ধরে আছে এআই (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) নামক লেখা ফিতা। শিক্ষার্থীরা জানান, সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে সিনেমার 'মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র' ধারণার আলোকে এবার মন্ডপের থিম সাজানো হয়েছে। যেখানে মিডিয়াকে বলা হয়েছে 'মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র'। বিভাগের শিক্ষার্থী প্রান্ত দত্ত বলেন, 'এটাকে আমরা আইডিয়োলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস হিসেবে ধরেছি। একটা ক্ষমতাসীন শ্রেণি যখন সাধারণ মানুষকে শাসন করতে চায়, তখন তারা এমন কিছু টুলস বেছে নেয়, যেগুলো প্রয়োগ করে সাধারণ মানুষকে মগজ ধোলাই করা হয়। মিডিয়া হলো সেই ধরনের একটা টুল। আজকে সত্য-ন্যায়ের কলম শিকলবদ্ধ। ক্ষমতাসীনরা যা প্রচার করছে, মানুষ তা গিলে খাচ্ছে। মিডিয়াকে তারা মস্তিষ্ক প্রক্ষালন যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।' সরস্বতীর পায়ের নিচে কেন ধ্রম্নপদী সাহিত্য ধুলোয় মলিন হয়ে পড়ে আছে, এমন প্রশ্নে প্রান্ত দত্ত বলেন, 'আজকে মুখস্ত নির্ভর এমসিকিউভিত্তিক যে শিক্ষাব্যবস্থা, সেটাকে আমরা তুলে ধরেছি। আজকে শিক্ষার্থীরা মুখস্থনির্ভর বিসিএসের গাইড বই নিয়ে ব্যস্ত। অথচ ক্লাসিক্যাল যে সাহিত্য, তা নোংরা অবস্থায় পড়ে আছে। আমাদের প্রশ্ন মেধা কি শুধু এমসিকিউ? এআই এসে পিছিয়ে দিয়েছে সৃজনশীলতার রূপ সরস্বতীকে। এখন আমরা মানুষের সৃষ্টিশীলতাকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে গুরুত্ব দিচ্ছি। সেই বিষয়টাও তুলে ধরেছি।' জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩৬টি মন্ডপে সরস্বতী পূজা উদযাপন করা হয়েছে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন পোগোজ ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজেও পূজা উদযাপিত হয়েছে। বিভিন্ন বিভাগের মন্ডপগুলোর সাজসজ্জায় স্বকীয়তা ফুটে উঠেছে। প্রায় প্রতিটি বিভাগ তাদের পঠিত বিষয়ের সঙ্গে মিল রেখে পূজা মন্ডপ সাজিয়েছে। গণিত বিভাগ তাদের মন্ডপের আলপনায় বিভিন্ন গাণিতিক সংকেত দিয়েছে। আবার প্রতিবছরের মতো চারুকলা বিভাগ প্রতিমায় নিয়ে এসেছে ভিন্নতা। 'বীণাপাণি' হাতে দেবীকে খুবই সাদামাটাভাবে উপস্থাপন করেছে তারা। নাট্যকলা বিভাগে নারী পুরোহিতের মাধ্যমে পূজা অর্চনা করা হয়েছে। বাণী অর্চনা শেষে উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক হুমায়ুন কবীর চৌধুরী সব পূজামন্ডপ পরিদর্শন করেন। এ সময় সঙ্গে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মোস্তফা কামালসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। শাঁখারীবাজার থেকে পরিবার নিয়ে ঘুরতে আসা রতন বৈদ্য বলেন, 'একসঙ্গে অনেক পূজা হওয়ার কারণে আমরা প্রতিবছর এখানে ঘুরতে আসি। খুব ভালো লাগছে সবগুলো পূজা দেখে। বিকালের দিকে যাই জগন্নাথ হলের পূজা দেখতে।' জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় পূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি অধ্যাপক রবীন্দ্রনাথ মন্ডল বলেন, 'খুব সুশৃঙ্খলভাবে আমরা পূজা উদযাপন করতে পেরেছি।'