আজ 'সুন্দরবন দিবস'
প্রাকৃতিক দুর্যোগে আগলে রাখে বাংলাদেশকে
প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আলতাব হোসেন
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবন শুধু প্রাণবৈচিত্র্যের আধারই নয়, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ঢালও বটে। বিশ্বের বৃহত্তম এ শ্বাসমূল বন ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আগলে রাখে বাংলাদেশকে। এ এক অপার বিস্ময়! প্রলংকরী ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, ফণি ও বুলবুল ক্ষত কাটতে না কাটতেই আম্পানের তান্ডবে রোধে মায়ের আঁচলের মতো বুক পেতে উপকূলীয় এলাকার মানুষ ও সম্পদ রক্ষা করেছে সুন্দরবন।
বাংলাদেশে উপকূলে আঘাত হানা ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের প্রথম বাধা ছিল সুন্দরবন। পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনের বাধা পেয়ে সিডর অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়ে। সুন্দরবন না থাকলে সিডরের ধাক্কা লাগত রাজধানী পর্যন্ত। সুন্দরবনের গাছপালায় বাধা পেয়ে সিডরের গতি ঘণ্টায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার কমে গিয়েছিল। ঠিক একইভাবে ২০০৯ সালে সুন্দরবনের কারণে ঘূর্ণিঝড় আইলার গতি ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ৪ ফুট কমে যায়। সম্প্রতি আঘাত হানা আরেক ঘূর্ণিঝড় আম্পানের গতিও ৭০ কিলোমিটার কমেছে সুন্দরবনের কারণে। এভাবেই বারবার নিজে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বাংলাদেশের
প্রকৃতি ও জীবনকে বাঁচিয়ে যাচ্ছে সুন্দরবন। বাংলাদেশে আঘাত হানা শক্তিশালী ঘূর্র্ণিঝড়ের বিরুদ্ধে লড়তে সুন্দরবন হয়ে উঠেছে রক্ষাকবচ।
আজ ১৪ ফেব্রম্নয়ারি 'সুন্দরবন দিবস'। সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে পালন করা হচ্ছে দিবসটি। ২০০১ সালের ১৪ ফেব্রম্নয়ারি বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের আওতায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনার স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন রূপান্তর ও পরশ-এর উদ্যোগে এবং দেশের আরও ৭০টি পরিবেশবাদী সংগঠনের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সুন্দরবন সম্মেলনে ১৪ ফেব্রম্নয়ারিকে 'সুন্দরবন দিবস' ঘোষণা করে প্রতিবছর পালন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে আজ সকাল ১১টায় জাতীয় জাদুঘরের সামনে সুন্দরবন বিনাসী সকল ধরনের অপতৎপরতা বন্ধের দাবিতের্ যালি, মানববন্ধন ও আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। বরাবরের মতো এবারেও সুন্দরবন দিবসের মূল অনুষ্ঠানটি হচ্ছে খুলনায়। দিবসটি উপলক্ষে বন বিভাগ নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে।
সুন্দরবন পৃথিবীর একক বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন। এ বনের ৬২ শতাংশ বাংলাদেশে এবং বাকি ৩৮ শতাংশ পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। বর্তমানে সুন্দরবনের আয়তন ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার। খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা ও বরগুনা জেলায় এ বনের অবস্থান। সুন্দরবনের অধিকাংশ গাছপালা ম্যানগ্রোভ ধরনের। উদ্ভিদবিজ্ঞানী ডি প্রেইন সুন্দরবনে ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে বলে উলেস্নখ করেন। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত সন্ধানপ্রাপ্ত ৫০টি ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের মধ্যে সুন্দরবনেই আছে ৩৫টি। সুন্দরবনে রয়েছে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ, ৩২০ প্রজাতির পাখি, ৮ প্রজাতির উভচর ও ৪০০ প্রজাতির মাছ। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার পৃথিবী বিখ্যাত। এছাড়া রয়েছে চিত্রা ও মায়া হরিণ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনে দৌরাত্ম্য বেড়েছে শিকারি আর পাচারকারী চক্রের। ফাঁদ পেতে ও গুলি করে শিকার করা হচ্ছে বাঘ ও হরিণ। প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে হরিণের মাংস। মাংস ও চামড়াসহ ধরাও পড়ছেন শিকারিরা। সুন্দরবনের নদী ও খালগুলোতে বিষ দিয়ে মাছ শিকারেও চলছে মহোৎসব। অবাধে বাঘ আর হরিণ শিকারের কারণে জীববৈচিত্র্যে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করেছেন পরিবেশবিদরা। ২০৫০ সালের মধ্যে সুন্দরবনের বাঘ হারিয়ে যাবার আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা। সুন্দরবনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলসহ গোটা দেশের পরিবেশ। তাই এ বন রক্ষায় সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং এক সঙ্গে কাজ করতে হবে প্রকৃতিকে ভালোবেসে।
সুন্দরবন রক্ষা করা না গেলে বাংলাদেশকে রক্ষা করার কোনো উপায় নেই বলে মন্তব্য করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সুন্দরবনকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার প্রধান রক্ষাকবচ হিসেবে উলেস্নখ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্বোধনকালে বলেছিলেন, 'আমরা গাছ লাগাইয়া সুন্দরবন পয়দা করি নাই। স্বাভাবিক অবস্থায় প্রকৃতি এটাকে করে দিয়েছে বাংলাদেশকে রক্ষার জন্য। বঙ্গোপসাগরের পাশ দিয়ে যে সুন্দরবনটা রয়েছে, এইটা হলো ব্যারিয়ার। এটা যদি রক্ষা না হয় তাহলে একদিন খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, কুমিলস্নার কিছু অংশ, ঢাকার কিছু অংশ এ পর্যন্ত সব এরিয়া সমুদ্রের মধ্যে চলে যাবে এবং এগুলো হাতিয়া-সন্দ্বীপের মতো আইল্যান্ড হয়ে যাবে। একবার যদি সুন্দরবন শেষ হয়ে যায়, তো সমুদ্র যে ভাঙনের সৃষ্টি করবে, সেই ভাঙন থেকে রক্ষার উপায় আর নেই।'