মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরকান আর্মির সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফের হোয়াইক্যং সীমান্তের নাফ নদের ওপারে মঙ্গলবারও গোলাগুলি হয়েছে। এ ছাড়া উখিয়া সীমান্তের ওপারেও কয়েকটি জায়গায় গোলাগুলি হয়েছে। এদিন ভোর থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত গোলাগুলির শব্দ পান সীমান্তের মানুষজন। ফলে আতঙ্ক পুরোপুরি কাটেনি এপারে। তবে সীমান্ত দিয়ে যাতে নতুন করে অনুপ্রবেশ ঘটতে না পারে সেজন্য বিজিবি সর্তক অবস্থানে রয়েছে।
এদিকে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের কারণে জ্বালানি, ভোজ্যতেল, ওষুধ ও খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে অসাধু ব্যবসায়ী ও সংঘবদ্ধ একটি চক্র টেকনাফ সীমান্ত দিয়ে পণ্য পাচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।র্ যাব জানিয়েছে, সোমবার রাতে পাচারের চেষ্টাকালে বেশকিছু নিত্যপণ্য জব্দ করা হয়েছে। এ সময় দুইজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জানা গেছে, মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা টেকনাফ অংশে দেশটির শহর বলিবাজার ও কুমিরখালী ঘাঁটি দখল নিতে চাচ্ছে। দেশটি সরকারি বাহিনী প্রতিরোধ করছে। এ নিয়ে চলছে তুমুল সংঘর্ষ। কুমিরখালী ঘাট বড় হওয়ায় বিদ্রোহীরা সহজে দখল নিতে পারছে না।
হোয়াইক্যং সীমান্তের বাসিন্দা শাহিন আলম সাংবাদিকদের জানান, সীমান্তে মঙ্গলবার সকাল থেকে থেমে থেমে গুলিবর্ষণ হয়। এখানকার লোকজন খুব ভয়ভীতির মধ্য রয়েছে।
হোয়াইক্যং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নুর আহমেদ আনোয়ারী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, তার এলাকায় হোয়াইক্যংয়ে নাফ নদের ওপারে গুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। লোকজনকে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। কিন্তু সীমান্ত দিয়ে কোনো লোকজন অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আমরাও সতর্ক অবস্থানে আছি।
টেকনাফ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সীমান্তে কিছু জায়গায় গুলিবর্ষণের খবর পেয়েছি। তবে অন্যদিনের তুলনায় সীমান্তে গোলাগুলি কমেছে। লোকজন যাতে অনুপ্রবেশ করতে না পারে সেজন্য আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। এখন পর্যন্ত ১৩৭
রোহিঙ্গাকে প্রতিহত করা হয়েছে।
নিত্যপণ্য পাচারের চেষ্টা
এদিকে, কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলায় ভোজ্যতেল, ওষুধ ও খাদ্যপণ্যসহ একটি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে।র্ যাবের দাবি, এসব পণ্য মিয়ানমারে পাচারের উদ্দেশ্যে মজুদ করা হয়েছিল।
র্
যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন মঙ্গলবার দুপুরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, সোমবার রাতে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাতিয়ারঘোনা এলাকা থেকে এসব নিত্যপণ্য উদ্ধার করা হয়। এ সময় পাচার কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তারা হলেন- হাতিয়ারঘোনা এলাকার আবুল বশরের ছেলে আব্দুল মান্নান (২৪) এবং একই এলাকার হাছন আলীর ছেলে আলী হোসেন (৪৫)। তাদের বিরুদ্ধে টেকনাফ থানায় মামলা হয়েছে।
কমান্ডার আল মঈন বলেন, 'মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরকান আর্মির চলমান সংঘাতের জেরে দেশটির রাখাইন রাজ্যের বেশকিছু এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতে ওই রাজ্যে জ্বালানি ও ভোজ্যতেল, ওষুধ ও খাদ্যপণ্যসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের সংকট দেখা দিয়েছে। সংকটজনক এ পরিস্থিতিতে অসাধু ব্যবসায়ী ও সংঘবদ্ধ একটি চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। সোমবার রাতে হাতিয়ারঘোনা এলাকায় আবুল বশরের বাড়িতে সংঘবদ্ধ পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য বেশকিছু পণ্য প্রতিবেশী দেশে পাচারের জন্য মজুদ করেছে খবরের্ যাবের একটি দল অভিযান চালায়। এ সময় টের পেয়ে ৪-৫ জন দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলে ধাওয়া দিয়ে দুইজনকে আটক করা হয়। পরে বশরের মুরগির খামারে মজুদ করা ৪ হাজার ৪৭০ লিটার সয়াবিন তেল, ৫০০ কেজি ময়দা ও ১ লাখ ৩৬ হাজার ৫৫০টি বিভিন্ন ধরনের ওষুধ পাওয়া যায়।'
গ্রেপ্তারদের বরাতে তিনি বলেন, 'তারা সীমান্তের বিভিন্ন চ্যানেল দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারে তেল, ওষুধ ও খাদ্যপণ্য পাচার করে আসছিল। এসব নিত্যপণ্যের বিনিময়ে তারা বাংলাদেশে মাদকের বড় বড় চালান নিয়ে আসত।'
রাখাইন রাজ্যের সংকটজনক পরিস্থিতিতের্ যাব সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি করেছে বলেও জানান আল মঈন।
টেকনাফ স্থলবন্দর ফাঁকা
এদিকে, কক্সবাজার থেকে আমাদের প্রতিনিধি জাবেদ আবেদীন শাহীন জানিয়েছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সংঘাতের প্রভাব সীমান্ত ছাড়িয়ে টেকনাফ স্থলবন্দরেও পড়েছে। যুদ্ধের কারণে বন্দরের কার্যক্রম অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে। পণ্য আমদানি-রপ্তানি বন্ধ থাকায় বন্দরের জেটি মূলত ফাঁকা। বন্দর থেকে রাজস্ব আয়ও নেমেছে শূন্যের কোটায়। ফলে বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হতাশা। তাদের অভিমত মিয়ানমারের যুদ্ধ পরিস্থিতি দীর্ঘ হলে বাণিজ্য সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
বন্দর সূত্র জানায, প্রতি মাসে মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের আমদানি-রপ্তানির কিছু লক্ষ্যমাত্রা থাকে। বিশেষ করে টেকনাফ বন্দরের সঙ্গে মিয়ানমারের সিটুয়ে এবং মংডু বন্দরের মধ্যে পণ্য আমদানি ও রপ্তানি হয। মিযানমার থেকে বাংলাদেশ পেঁযাজ, আদা, রসুন, সুপারি, হিমায়িত মাছ এবং গাছ আমদানি ও মৌসুমে গরুও আসে। এর বাইরে আচারের মতো কিছু অপ্রচলিত পণ্যও আমদানি করা হয। পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় তৈরি পোশাক, ওষুধ, প্রসাধনী, খাদ্যসামগ্রী ও পস্নাস্টিকের তৈরি বিভিন্ন পণ্যসহ আরও বেশকিছু পণ্য। সীমান্ত পরিবেশ শান্ত থাকায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ ৬৬ কোটি টাকা শুল্ক বাবদ পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে আদায় হয়েছে। বর্তমানে টেকনাফ বন্দরে বাণিজ্য বন্ধ থাকায় ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট ও শ্রমিকদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে।
শুল্ক বিভাগের তথ্যমতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বন্দরের রাজস্ব আয় ছিল ৩ কোটি ৬৮ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬ কোটি ৫০ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩ কোটি ৫৮ লাখ, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৯ কোটি ২৩ লাখ, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রাজস্ব ছিল ৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। অর্থবছর ২০২২-২৩ সালে আমদানি ১,৯৯,২১৯ মেট্রিক টন ও রপ্তানি ৩৫২৩ মেট্রিক টন। বিপরীতে রাজস্ব আয় ৭৬৩ কোটি টাকা।
বন্দরে শ্রমিক ইদ্রিস আলী বলেন, মিয়ানমারে যুদ্ধের কারণে সীমান্ত আশান্ত হয়ে পড়ায় টেকনাফ বন্দর বন্ধ রয়েছে। কাজ না থাকায় এখন সংসার চালাতে খুবই কষ্ট হচ্ছে।
টেকনাফ স্থল বন্দরে কেএল শিপিংয়ের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট আয়াতুল ইসলাম জানান, মিয়ানমারে সংঘাতের আমদানি-রপ্তানিতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। মিয়ানমার থেকে পণ্য আমদানি করতে না পারি, তাহলে আমরা সবাই বিপদে পড়ে যাব। স্বাভাবিক সময়ে অন্তত ১২ থেকে ১৫টি ট্রলার পণ্য নিয়ে মংডু থেকে টেকনাফে আসে। কিন্তু এখন বন্ধ।
তিনি আরও বলেন, এর আগে বন্দরে পণ্য খালাসের সময় প্রতি মাসে দেড়শ থেকে দুইশ ইঞ্জিনচালিত বড় ট্রলারে পণ্য আনা-নেওয়া হতো, সেখানে গত আড়াই মাসে এসেছে ২৫ থেকে ৩০টি। যা এখন শূন্য কোটা বলা চলে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের উৎপাদিত পণ্য বিশেষ করে পস্নাস্টিক এবং নির্মাণসামগ্রীর অনেক চাহিদা রয়েছে সেখানে। মিয়ামারে সংঘাত চললেও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এই বন্দর সমস্যার সমাধান করা উচিত।
টেকনাফ স্থলবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তা এ এসএম মোশাররফ হোসেন বলেন, মিয়ানমারে যুদ্ধের কারণে স্বাভাবিক কারণে টেকনাফের স্থলবন্দর হয়ে আমদানি-রপ্তানিতে এক ধরনের প্রভাব পড়েছে। প্রতিদিন তিন কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রাজস্ব আদায়ে গতি আসবে বলে জানান তিনি।