রাষ্ট্রভাষা বাংলা রক্ষার দাবিতে ১৯৪৮ সালের মার্চে সীমিত পর্যায়ে যে আন্দোলন শুরু হয়, ১৯৫২ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে এসে তার চরম প্রকাশ ঘটে। ফেব্রম্নয়ারির ১১ ও ১৩ তারিখ পতাকা দিবস পালনের পর পূর্বঘোষিত ২১ ফেব্রম্নয়ারি সর্বাত্মক অবরোধ পালনের প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে দিন পার করছিলেন ছাত্র নেতারা। ইতোমধ্যে পূর্ববাংলার প্রায় সব জেলা ও মহকুমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পৌঁছে যান। সেখানে গিয়ে তারা ২১ ফেব্রম্নয়ারি পালনের জন্য ছাত্র-জনতাকে উদ্বুদ্ধ করেন।
উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার পেছনে বাঙালিদের ওপর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রভুত্ব কায়েম করা ও শোষণের অভিসন্ধি বলে মনে করা হয়েছিল। এতে বাঙালিদের মনে পাকিস্তানের প্রতি অবিশ্বাসের ভিত তৈরি হয়েছিল। এ আন্দোলন প্রাথমিক অবস্থায় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ থাকলেও বায়ান্নর ২৬ জানুয়ারি পাকিস্তানের অ্যাসেম্বলিতে উর্দুকেই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে পরিস্থিতি পাল্টে যায়।
অন্যদিকে পূর্ব বঙ্গের অধিবাসী হওয়া সত্ত্বেও ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহর কথার পুনরাবৃত্তি করেন। সেই সময়ও একইভাবে জোরাল প্রতিবাদ ওঠে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'।
'৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের পল্টনের জনসভায় বক্তব্যের পর তা সর্বস্তরে ছড়িয়ে যায়। এদিকে জেলখানায় থাকা শেখ মুজিবুর রহমান একুশে ফেব্রম্নয়ারি থেকে জেলখানায় অনশন পালনের ঘোষণা দেন। তৎকালীন পাকিস্তানি শাসক তাকে ঢাকা থেকে অন্যত্র সরানোর পরিকল্পনা করে। প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী 'একুশকে নিয়ে কিছু স্মৃতি, কিছু কথা' প্রবন্ধে লিখেছেন,
'শেখ মুজিব ১৯৫২ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসের ১৬ তারিখ ফরিদপুর জেলে যাওয়ার আগে ও পরে ছাত্রলীগের একাধিক নেতার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছেন। (ভালোবাসি মাতৃভাষা-পৃষ্ঠা-৬২)।
তবে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ২১ ফেব্রম্নয়ারির অবরোধ কর্মসূচিতে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল করলে পাকিস্তান সরকার সেই মিছিলে বর্বরভাবে গুলি চালায়। সেখানে অনেকে নিহত হন। ভাষা আন্দোলনে এতদিন পরও ভাষা শহীদদের সঠিক পরিসংখ্যান উদ্ঘাটনে কাউকে ব্রত হতে দেখা যায়নি। ভাষা আন্দোলনে জ্ঞাত ভাষাশহীদের সংখ্যা অনেকে ৫ বলে উলেস্নখ করেন। শহীদ অহিউলস্নাহকে নিয়ে জ্ঞাত ভাষাশহীদের সংখ্যা হবে সম্ভবত ৬। আট বছরের বালক অহিউলস্নাহ রাষ্ট্রভাষা বাংলার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে শহীদ হন। বিভিন্ন পুস্তকে উলিস্নখিত রেফারেন্স অনুযায়ী তিনি ছিলেন ঢাকার নবাবপুর রোডে বসবাসকারী রাজমিস্ত্রি হাবিবুর রহমানের ছেলে। শহীদ হওয়ার সময় তিনি তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। অহিউলস্নাহ শহীদ হন ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রম্নয়ারি নবাবপুর রোডে খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে। শহীদ হওয়ার সময় তার মুখে এক টুকরো কাগজ ছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে এবং ২১ ফেব্রম্নয়ারির হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে ২২ ফেব্রম্নয়ারি ঢাকায় মিছিল বের হয়। মিছিলটি নবাবপুর রোড দিয়ে অতিক্রম করার সময় বালক অহিউলস্নাহ কাগজ চিবুতে চিবুতে মিছিলে শরিক হন। এমন সময় তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
২২ ফেব্রম্নয়ারি দৈনিক আযাদ পত্রিকায় চারজন ভাষাশহীদ সালাউদ্দীন, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত এবং রফিকউদ্দিনের তালিকা প্রকাশ করে। কিন্তু ওইদিন সালাউদ্দীন নামে কেউ শহীদ হননি। রফিকউদ্দিনকে সালাউদ্দীন ভাবা হয়েছিল। তারই সূত্র ধরে বদরুদ্দীন উমর 'পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি গ্রন্থে ২১ ফেব্রম্নয়ারির শহীদ সংখ্যা নিধার্রণে সালাউদ্দীনের নামসহ তালিকাটি প্রকাশ করেন। সে হিসেবে ২১ ফেব্রম্নয়ারিতে ভাষা শহীদের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩ জন। প্রাপ্ত গ্রন্থটিতে ২২ ফেব্রম্নয়ারির শহীদের সংখ্যা ২ এবং একজন আহত কিশোরের উলেস্নখ করা হয়েছে। তাহলে বদরুদ্দীন উমরের গ্রন্থে ২১-২২ ফেব্রম্নয়ারিতে ৫ জন শহীদের সন্ধান মিলছে। আহমেদ রফিক 'একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস' গ্রন্থে ২১ ফেব্রম্নয়ারি ৩ জন শহীদের নিহত হওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন। তবে তিনি ২২ ফেব্রম্নয়ারির শহীদের উলেস্নখ করেননি। ভাষাশহীদের সংখ্যা সম্পর্কে সবচেয়ে ব্যতিক্রম তথ্য দিয়েছেন গবেষক ও লেখক গোলাম মুরশিদ 'মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর' গ্রন্থে। তিনি ২১ ফেব্রম্নয়ারি রফিকউদ্দিন, আবুল বরকত, বছর দশেকের একটি ছেলে, এক রিকশাওয়ালা উলেস্নখ করে আবার বলেছেন 'মোটকথা এদিন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার প্রমুখ বেশ কয়েকজন নিহত হন। আবার ২২ ফেব্রম্নয়ারির 'আযাদ' পত্রিকার বরাত দিয়ে বলেন 'গুলিতে ঘটনাস্থলে চারজন নিহত ও সতেরোজন আহত হয়েছিল। আহতদের মধ্যে পরে হাসপাতালে মারা যান তিনজন। ২২ ফেব্রম্নয়ারির শহীদ সম্পর্কে বলেন, 'এতে কয়েকজন নিহত হয়েছিল' বলে শফিউর রহমান ও কিশোর অহিউলস্নাহর নাম উলেস্নখ করেন। ফলে শেষ পর্যন্ত তারিখ অনুসারে এবং মোট ভাষাশহীদের সংখ্যা নির্ধারণে ভ্রান্তিতে ফেলে দেয়।