জাপানি তিন শিশুকে বাবা ও মায়ের মধ্যে ভাগাভাগি
প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
দীর্ঘদিনের আইনি লড়াইয়ের মধ্যে সন্তানদের জিম্মা পেতে বড় ও ছোট মেয়েকে জাপানি মায়ের কাছে এবং মেজ মেয়েকে বাবার কাছে রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে হাইকোর্ট। তবে বাবা ও মা দু'জনই চাইলে তাদের সব সন্তানের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন।
আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বড় মেয়ে জেসমিন মালিকা ও ছোট মেয়ে সোনিয়া থাকবে তাদের মা নাকানো এরিকোর কাছে। আর মেজ মেয়ে লাইলা লিনা থাকবে বাংলাদেশি বাবা ইমরান শরীফের কাছে।
এক বছর আগে জাপানি দুই শিশুকে (বড় দুজন) তার মায়ের জিম্মায় দিয়ে ঢাকার জেলা জজ আদালত যে আদেশ দিয়েছিল, সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বাবা ইমরান শরীফের করা আবেদন আংশিক মঞ্জুর করে মঙ্গলবার এরায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আদালতে এদিন ইমরান শরীফের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আখতার ইমাম, রাশনা ইমাম, নাসিমা আক্তার লাভলী। নাকানো এরিকোর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি, মোহাম্মদ শিশির মনির।
এর আগে গত বছরের ৯ মার্চ বড় ও মেজ মেয়েকে বিদেশে নিয়ে যেতে নাকানো এরিকোর আবেদন নাকচ করে আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে দুই শিশু কার জিম্মায় থাকবে- এ সংক্রান্ত আপিল জেলা জজ আদালতকে তিন মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই সময় পর্যন্ত দুই শিশু যেভাবে আছে সেভাবেই রাখার নির্দেশ দেয় প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ
সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন ৭ বিচারপতির আপিল বেঞ্চ।
তারও আগে গত বছরের ২৯ জানুয়ারি দুই শিশুকে জাপানি মায়ের জিম্মায় দেয় আদালত। ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমানের ওই রায়ে বলা হয়, মামলাটির বিচার করার এখতিয়ার এই আদালতের আছে- এমনটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বাদী (শিশুদের বাবা)। তাছাড়া বাদী-বিবাদী ও শিশু দুটির সর্বশেষ বসবাসের স্থান জাপান হওয়ায় পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এর ধারা ৬ (১) অনুযায়ী মামলাটি চলতে পারে না।
এদিকে, মামলার নথি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশি প্রকৌশলী ইমরান শরীফ জাপানের অবস্থান কালে ২০০৮ সালে জাপানি চিকিৎসক নাকানো এরিকোর সঙ্গে বিয়ে হয়। টোকিওতে এক যুগের দাম্পত্য জীবনে তারা তিন মেয়ের বাবা-মা হন।
দাম্পত্য কলহের জেরে ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি বিচ্ছেদের আবেদন করেন নাকানো। এরপর স্কুলবাসে করে বাড়ি ফেরার পথে বাস স্টপেজ থেকে ইমরান বড় দুই মেয়েকে একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যান বলে নাকানোর ভাষ্য।
ওই বছর ২৮ জানুয়ারি সন্তানদের জিম্মা চেয়ে টোকিওর পারিবারিক আদালতে মামলা করেন নাকানো। আর ইমরান ২১ ফেব্রম্নয়ারি বড় ও মেজ মেয়েকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। ছোট মেয়ে থেকে যায় জাপানে।
মেয়েদের ফিরে পেতে করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে ২০২১ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশে আসেন নাকানো। তিনি হাইকোর্টে রিট আবেদন করলে তাদের সমঝোতায় আসতে বলে বিচারক।
কিন্তু ওই দম্পতি সমঝোতায় না আসায় কয়েক মাস ধরে শুনানির পর ওই বছরের ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট দুই সন্তানকে বাবার হেফাজতে রাখার সিদ্ধান্ত দেয়। পাশাপাশি মা যাতে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন, তা নিশ্চিত করতে বাবাকে খরচ দিতে বলা হয়।
ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন করেছিলেন মা নাকানো। পরে আপিল বিভাগ ওই বছর ১৫ ডিসেম্বর এক আদেশে শিশু দুটিকে মায়ের জিম্মায় রাখার নির্দেশ দিলেও বাবা তা না মানায় বিচারকরা উষ্মা প্রকাশ করেন।
পরে আদালত শিশু দুটিকে বাবার হেফাজত থেকে এনে তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং পরে মায়ের হেফাজতে দেওয়ার আদেশ দেয়।
এরপর আপিল বিভাগ সিদ্ধান্ত দেয়, দুই মেয়ে কার জিম্মায় থাকবে তার নিষ্পত্তি পারিবারিক আদালতে হবে এবং তার আগ পর্যন্ত দুই শিশু তাদের মায়ের কাছেই থাকবে।
২০২২ সালের ১৩ ফেব্রম্নয়ারি ওই রায় দেওয়া হয়। এরপর আপিল বিভাগ থেকে মামলাটি পারিবারিক আদালতে যায়।
পরের বছর ২৯ জানুয়ারি ইমরান শরীফের করা মামলা খারিজ করে দিয়ে দুই শিশুকে মা নাকানো এরিকোর জিম্মায় রাখার সিদ্ধান্ত দেন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত সহকারী জজ ও পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান।
নাবালিকা দুই শিশু কার কাছে থাকলে কল্যাণ হবে, সেই বিবেচনা থেকে বিচারক ওই রায় দেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, 'জাপানে বেড়ে ওঠা দুই শিশুর প্রাথমিক শুশ্রূষাকারী তাদের মা নাকানো এরিকো। অথচ তাকে কিছু না জানিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া হঠাৎ অন্য একটি দেশে নিয়ে আসাটা মাতৃত্বের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন রূপটিকে অসম্মান করার নামান্তর।'
সেই রায়ে আদালত আরও বলে, 'বাবা হিসেবে ইমরান শরীফ নাবালিকা দুই সন্তানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার পূর্ণ হকদার। তবে জাপানি মায়ের কাছে দুই নাবালিকার হেফাজত তাদের শারীরিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক, তথা সার্বিক মঙ্গলজনক হবে বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।'
ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে ঢাকার জেলা জজ আদালতে আপিল করেন ইমরান শরিফ। ১৬ জুলাই তা খারিজ হয়ে গেলে তিনি আসেন হাইকোর্টে। চার বছর ধরে চলা এ মামলায় এবার তিন সন্তানকে ভাগ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত এলো উচ্চ আদালত থেকে।