বিএনপির কূটনৈতিক উইং বেশি হতাশ করেছে
প্রকাশ | ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে আন্দোলনের ব্যর্থতার বিষয় নিয়ে গত দেড় দশক ধরে সমালোচনা আছে। সর্বশেষ আন্দোলন সফলে মাঠ পর্যায়ের শক্তি সামর্থ্যের চেয়ে কূটনৈতিক বিষয়ে দেখভাল করা নেতাদের কাছে প্রত্যাশা বেশি ছিল। কিন্তু নির্বাচনের আগে-পরে আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে প্রত্যাশিত বার্তা না আসায় সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছেন দলের নেতাকর্মী। সঙ্গত কারণে এ প্রক্রিয়ায় নতুন নেতাদের যুক্ত করতে চাপে আছেন দলটির হাইকমান্ড।
বিএনপির অনেকে মনে করেন আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার বড় কারণ ছিল বিদেশনির্ভরতা। বিশেষ করে পুরো আন্দোলনে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল বিএনপির নেতৃত্ব। নেতাকর্মীদের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি করা হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাসহ জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে এমন কিছু পদক্ষেপ আসবে, তাতে সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান, বক্তব্য ও বিবৃতি বিএনপিকে আশাবাদী করে তুলেছিল। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারকে বিভিন্ন দেশের সমর্থন এবং সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দেওয়ার পর দলের নেতাকর্মী বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন।
জানা গেছে, নির্বাচন ইসু্যতে সামগ্রিক আন্দোলন ব্যর্থতার মূল্যায়ন হয়েছে বিএনপি ও শরিকদলে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আন্দোলনে পরিকল্পনায় ভুল ও কূটনৈতিক তৎপরতায় ব্যর্থতা ছিল বলে মূল্যায়নে উঠে এসেছে। বিএনপির বিভিন্ন বিশ্লেষণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী নাম সবার আগে উঠে আসে।
আন্দোলনের পর এখন দলে তাকে নিয়ে সমালোচনাও বেশি হচ্ছে। বর্তমানে কারাগারে থাকা এই নেতার অনুস্থিতিতে কাজ করতে গিয়ে দলের অন্য সিনিয়র নেতারা বুঝতে পেরেছেন, কূটনৈতিক পর্যায়ে নিরন্তর যোগাযোগ ছিল না তার। শুধু চিঠি চালাচালি আর ইসু্যভিত্তিক দেখা-সাক্ষাতের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাদের কার্যক্রম। ফলে কূটনৈতিক পর্যায়ে বিএনপির সঙ্গে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সেভাবে বোঝাপড়া গড়ে ওঠেনি। অথচ যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সঙ্গে বিএনপির ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা প্রচার করে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের বিদেশনির্ভরতা তৈরি করেন তিনিসহ তার ঘনিষ্ঠরা।
অভিমানে নিষ্ক্রিয় থাকা দলের কূটনৈতিক উইংয়ের এক সদস্য নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, অনার্থক কারণে প্রভাবশালী নেতাদের খুশি করতে বা পারিবারিক রাজনীতি সুপ্রিতিষ্ঠিত করতে বেশকিছু সিনিয়র নেতার সন্তানদের আন্তর্জাতিক কমিটিতে যুক্ত করেছে বিএনপি। তারা পদে থেকেছে অথচ এই কমিটির কি কাজ তা সম্পর্কে অনেকে অবগত নন। এই কমিটিতে থেকে আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাইডেনের ভুয়া উপদেষ্টাকে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করার সুযোগও দেওয়া হয়েছে। অযোগ্যদের অতি মূল্যায়নের কারণে সুযোগ্যরা মান বাঁচাতে নিষ্ক্রিয় হয়েছে। ফলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া পরাশক্তি দেশগুলোর কাছে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে এক ধরনের আস্থাহীনতা আছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা রাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো প্রভাবশালী দেশের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হতে না পারায় তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি বেশিদূর এগোতে পারেনি।
এই নেতা আরও বলেন, অতিমাত্রায় যুক্তরাষ্ট্র নির্ভরতা বিএনপির জন্য কাল হয়েছে। বাস্তবতা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র তো সুষ্ঠু নির্বাচন করে দেওয়ার দায়িত্ব নেয়নি। এ অবস্থা তৈরিতে বিএনপির সাংগঠনিকভাবে ব্যর্থ ছিল।
জানা যায়, সম্প্রতি তারেক রহমানের উপস্থিতিতে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও কূটনৈতিক ব্যর্থতার বিষয়টি উঠে আসে। এ বৈঠকে বিএনপির কূটনৈতিক অবস্থান ঠিক করার পরামর্শ দেন নেতারা। পাশাপাশি বন্ধু-শত্রম্ন রাষ্ট্র চিহ্নিত করতে কূটনৈতিক উইং ঢেলে সাজানো পরামর্শ দেন তারা।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, ভূ-রাজনৈতিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ দেশ ভারত আওয়ামী লীগের বিশ্বস্ত বন্ধু। রাশিয়া ও চীনও তাদের পক্ষে। এর বিপরীতে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে চীনের সঙ্গে যে বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল, তারও উন্নতি হয়নি। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে গিয়ে পাকিস্তানকে অবহেলা করা হয়েছে। মুসলিম বিশ্ব অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছেও বিএনপি ধীরে ধীরে তার গুরুত্ব হারিয়েছে। ভারত, চীন ও রাশিয়া যেভাবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারকে গুরুত্ব দেয়, সেভাবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব দলগতভাবে বিএনপিকে সেই গুরুত্ব দেয় না।
জানা গেছে, শুধু বিএনপিই নয় এর বাইরে নির্বাচন ঘিরে সরকার পতন আন্দোলনে পরিকল্পনায় ভুল ও কূটনৈতিক তৎপরতায় ব্যর্থতা ছিল বলে শরিক দলগুলোর মূল্যায়নে উঠে এসেছে। হঠাৎ বিএনপির ভারতবিরোধী রাজনীতির সমালোচনা করেন শরিকদের কেউ কেউ।
নির্বাচনের আগে বিএনপির কূটনিতিক উইংয়ের কার্যক্রম প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র নেতা বলেন, কূটনৈতিক উইংয়ের দায়িত্বশীল নেতাদের এমন মনোভাব ছিল, তাদের সঙ্গে ইউরোপ-আমেরিকার ভালো বোঝাপড়া আছে। বাস্তবে ইউরোপ-আমেরিকা সরকারের নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে শক্তভাবে বলেছে। সেটা বিএনপির পক্ষে গেছে। কিন্তু তারা তো বিএনপির পক্ষে কথা বলেনি। এই উইংয়ের শীর্ষ নেতাদের কেউ কেউ দলীয় ফোরামে পর্যন্ত বলেছেন, নির্বাচন ইসু্যতে ভারত নিরপেক্ষ থাকবে। এজন্য জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু এর কিছুই হয়নি। বরং ভারতের সমর্থন এ সরকারকে বিশেষ সুবিধা দিয়েছে।
এ বিষয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে 'ভারত পরিষ্কার হস্তক্ষেপ করেছে'।