প্রকৃতি তার আপন নিয়মে শীতের আড়ষ্টতা ভেঙে জেগে উঠেছে। চারদিক আলোকিত করে, ফুলে ফুলে সুরভিত হয়েই এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। গাছে গাছে নতুন পাতা। শিমুল-পলাশের ডালে যেন লেগেছে আগুন। ইট কাচ ইস্পাতের নগরীতে পর্যন্ত কানে মধু ঢালছে কোকিলের কুহু তান। ঋতুরাজ বসন্ত খুলতে শুরু করেছে তার অপরূপ ডালি।
বাংলা পঞ্জিকার হিসাব অনুযায়ী, আজ বুধবার বসন্তের প্রথম দিন, পহেলা ফাল্গুন। পশ্চিমা রীতির 'ভ্যালেনটাইনস ডে' বা 'ভালোবাসা দিবস'ও আজ। কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন- 'ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক আজ বসন্ত।' বসন্তে নৈসর্গিক প্রকৃতি বর্ণচ্ছটায় রঙময় হয়ে ওঠে। কচি পাতায় আলোর নাচনের মতোই বাঙালি তরুণ মনেও লাগে দোলা। হৃদয় হয়ে ওঠে উচাটন। আজ পহেলা
ফাল্গুন ও বিশ্ব ভালোবাসা দিবস এক দিনেই উদযাপন করছে উৎসবপ্রিয় বাঙালি।
প্রতিবছর ১৪ ফেব্রম্নয়ারি বিশ্বজুড়ে পালিত হয় এদিনটি। বাংলার বর্ণিল বসন্ত আর ভিনদেশি আত্মত্যাগী সাধু ভ্যালেনটাইনের প্রেমের রং মেখে প্রীতি আর ভালোবাসা বিনিময়ে মাতবে সবাই। শীতের হিম, কুয়াশা আর শুষ্কতা প্রকৃতিকে করে তোলে ম্রিয়মাণ। অনেক ধরনের গাছের পাতা ঝরে যায়, হারিয়ে যায় শ্যামলিমা।
মাঘের শেষে ফাল্গুন আবার বিবর্ণ প্রকৃতিতে প্রাণ ফিরিয়ে আনে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'নবীন বসন্ত আইল নবীন জীবন ফুটাতে।' রাজধানীসহ নগরগুলো ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে প্রাকৃতিক সবুজ, কালের প্রবাহে পলস্নীবাংলার সবুজেও থাবা দিচ্ছে জনবসতির চাপ। তবু এককালের ষড়ঋতুর এ দেশের মানুষ বসন্তে এখনো কম-বেশি উদ্বেল হয়। নবজীবনের প্রতীক বসন্তের প্রভাব মানুষের মনে পড়েই।
বাঙালির জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে আছে বসন্ত। বসন্তের বন্দনা আছে কবিতা, গান নৃত্য আর চিত্রকলায়। প্রিয়জনের স্পর্শ পাওয়ার আকুলতা বসন্তে যেন ধরা দেয় ভিন্ন রূপে। প্রকৃতির রং লাগে মানুষের মনেও। ফাগুনের রক্ত রাঙা দিনে বাতাসে মিশে থাকে ভালোবাসা। তাইতো ফাগুন বন্দনায় মুখর প্রকৃতিপ্রেমীরা। সোনালি রোদের ছোঁয়ায় পলাশগুলো জেগে উঠবে আজ। মৌমাছিদের গুঞ্জরণ, মাতাল হাওয়া ছুঁয়ে যাবে তনুমন। ফাগুনের আগুনলাগা উচ্ছ্বাস প্রিয়তমের হাতে হাত রেখে প্রিয়ার কোমল হৃদয় ব্যাকুল হয়ে উঠবে ঘরবাঁধার স্বপ্নে।
হৃদয়ে বসন্তের উষ্ণতা নিয়ে আজ বাইরে পা দেবেন অনেকেই। প্রিয়জনকে নিয়ে ভালোবাসার দিগন্ত ছুঁতে চাইবেন তারা। একটি দিন প্রিয় মানুষের সঙ্গে একান্তে নিজেদের মতো করে কাটাবেন। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম দিনটিকে বেছে নেবে মনের মানুষের কাছে প্রণয়ের কথা নিবেদনের জন্য। গোলাপের গুচ্ছ নিয়ে একসঙ্গে বাইরে ঘুরে বেড়ানো, কোথাও খেতে যাওয়ার মধ্য দিয়ে দিনটি কাটবে অনেকের। কারো প্রেমের প্রথম কুঁড়িটিও হয়তো লাজুক চোখ মেলে তাকাবে পয়লা বসন্তের আলোয়।
রাজধানীতে বরাবরের মতোই আজ বসন্ত উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ প্রাঙ্গণ। বাসন্তী রং আর নাচে-গানে জমে উঠবে বসন্ত উৎসব। জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদের উদ্যোগে সকাল থেকে চারুকলা অনুষদের বকুলতলায় যন্ত্র-সঙ্গীতের সুরমূর্ছনা দিয়ে শুরু হবে এ উৎসব। বকুলতলা সাজবে বাসন্তী রাঙা ভালোবাসায়। গান, কবিতা আর সম্মেলক নৃত্যে শুরু হবে নগরবাসীর বসন্ত উদযাপন। বকুলতলার আনাচে-কানাচে বসন্তের বন্দনা-গানে মেতে উঠবে নগরবাসী।
ফাগুনের উৎসবের এই রং চারুকলা থেকে ছড়িয়ে পড়বে পুরোবিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। সেখান থেকে পুরোনগরে। অনেকেরই পোশাকে থাকবে বসন্তের আবহ। সংখ্যায় কম হলেও গতকালও দেখা গেছে তার কিছু নমুনা। হলদে শাড়ি আর ফুলের মুকুটে সাজা অনেক নারীরই দেখা মিলেছে পথে। বসন্ত উৎসবের পাশাপাশি অমর একুশে বইমেলায়ও আজ একবার ঢুঁ মারবেন বহু মানুষ।
এবার বসন্ত রাঙাবে বৃষ্টি!
এদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ফাগুনের প্রথম দিন আজ বুধবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হতে পারে।
আবহাওয়াবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, 'বুধবার বিকাল থেকে রংপুর, রাজশাহী, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের দুয়েক জায়গায় বৃষ্টি হতে পারে। সকাল থেকেই রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের আকাশ মেঘলা থাকবে।'
বাংলাদেশে শীতের মৌসুম সাধারণত ধরা হয় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রম্নয়ারি। ঋতু পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে আবহাওয়াগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বসন্তের শুরুতে, বিশেষ করে ফেব্রম্নয়ারির দ্বিতীয়ার্ধে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ঝড়-বৃষ্টি এবং শিলাবৃষ্টির প্রবণতা থাকে।