পুলিশের পোশাক ও সরঞ্জামাদি বিক্রিতে অনিয়ম ঠেকাতে গঠিত হয়েছে বিশেষ টিম। যেন পুলিশ সদস্য ছাড়া কেউ বাহিনীটির পোশাক ও সরঞ্জাম কিনতে না পারে। টিমটি বিক্রেতাদের রেজিস্টার নিয়মিত চেক করছে। যাচাইবাছাই করা হচ্ছে ক্রেতাদের পরিচয়। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশ মেনে অবশ্যই পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রি করতে হবে। অন্যথায় বিক্রেতার লাইসেন্স বাতিলসহ আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার নয়াপল্টনে অবস্থিত পলওয়েল সুপার মার্কেটটিতে সবচেয়ে বেশি বাহিনীটির পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রি হয়। দেশের অধিকাংশ পুলিশ সদস্যই মার্কেটটি থেকে পোশাক কেনা বা তৈরি করে থাকেন। বিক্রি করা সরঞ্জামের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হ্যান্ডকাপ। এছাড়া রয়েছে লেজার লাইট ও পিস্তল রাখার হোলস্টারসহ আনুষঙ্গিক কিছু সরঞ্জাম।
ডিবি প্রধান ও ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ডিআইজি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, প্রায়ই ডিবি পরিচয়ে নানা ধরনের অপরাধ সংঘটিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। মূলত ডিবির পোশাকের আদলে পোশাক তৈরি করে অপরাধীরা অপরাধ করে। এ ধরনের পোশাক কে বা কারা কোথায় তৈরি করে সে বিষয়ে জানতে ডিবি পুলিশের সব ইউনিটকে কড়া নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ঢাকার বিভিন্ন মার্কেটে পুলিশের সরঞ্জাম বিক্রিতে কড়াকড়ি আরোপ করার পাশাপাশি কঠোর গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি জানান, পুলিশের সরঞ্জামের সঙ্গে পুলিশের ভাবমূর্তি জড়িত। তাই পুলিশের সরঞ্জাম বিক্রির বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মনিটরিং করা হয়। পোশাক ও পুলিশের সরঞ্জাম বিক্রির নির্দেশিকা আছে। তা অবশ্যই দোকানিদের মানতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সারাদেশে পুলিশের সরঞ্জাম বিক্রির বিষয়ে কথা হয় পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুলস্নাহ আল-মামুনের সঙ্গে। তিনি যায়যায়দিনকে পুলিশের সরঞ্জাম ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্কিত নানা বিষয় তুলে ধরেন। বলেন, পুলিশের সরঞ্জামের সঙ্গে পুলিশের ভাবমূর্তি জড়িত। কারণ পুলিশের নকল পোশাক ব্যবহার করে অপরাধীরা অপরাধ করে। অথচ সেই অপরাধের
দায় চাপে পুলিশের ঘাড়ে। এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে খারাপ ধারণার জন্ম হয়। এছাড়া আগে প্রায়ই পুলিশের হ্যান্ডকাপ পরিহিত অবস্থায় লাশ উদ্ধার হয়েছে। গত প্রায় দুই বছরে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে সহসাই পুলিশের হ্যান্ডকাপ পরিহিত লাশ উদ্ধার বা পুলিশের আসল পোশাক পরিধান করে কোনো অপরাধী বা চক্রের অপরাধ করার তেমন কোনো ঘটনা ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, 'পুলিশের পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রিতে অনিয়ম ঠেকাতে বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। টিম সদস্যরা ছদ্মবেশে নিয়মিত পুলিশের পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রির দোকানগুলোতে নজরদারি করছেন। আমি নিজেই এমন গোয়েন্দা ইউনিট গঠন করেছি। নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট দিয়ে বিষয়টির নিয়মিত মনিটরিং করছি। প্রায়ই গোয়েন্দা সদস্যদের পোশাক বা পুলিশের সরঞ্জাম কিনতে দোকানে পাঠিয়ে দেই। অথবা দোকানের সামনে বসিয়ে রাখি। দোকানি যদি তার পরিচয়,র্ যাঙ্কসহ যাবতীয় তথ্য ছাড়াই পোশাক বা সরঞ্জাম বিক্রি করতে রাজি হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে ওই দোকানি সম্পর্কে বিস্তারিত আমাকে জানায়। যাচাইবাছাই শেষে তার লাইসেন্স বাতিলসহ তাকে কালোতালিকাভুক্ত করি। প্রয়োজনে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে আইনের আওতায় আনার নির্দেশনা দিয়েছি।'
পুলিশ প্রধান আরও বলেন, দোকানি সত্যি সত্যি কোনো পুলিশ সদস্যদের কাছে পোশাক বা অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রি করছেন কিনা এবং বিক্রির যে শর্ত আছে তা পালন করছেন কিনা এমনকি দোকানি ক্রেতার যাবতীয় তথ্য রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ করছেন কিনা তা টিমের সদস্যদের নিয়মিত আমার কাছে রিপোর্ট করতে হয়। হঠাৎ করেই দোকানদার রেজিস্টারসহ পুলিশ সদর দপ্তরে হাজির হতে বলা হয়। বিশেষ টিমের সদস্যরা রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ থাকা ক্রেতাদের নাম পরিচয় ঠিক আছে কিনা অর্থাৎ ক্রেতা প্রকৃত পুলিশ সদস্য কিনা তা যাচাই করে। এছাড়া ক্রেতারা যেসব ইউনিটের সদস্য ওইসব ইউনিটের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ক্রেতার পরিচয় নিশ্চিত করা হয়।
পুলিশ প্রধানের এমন পদক্ষেপ কতটা কার্যকর হয়েছে সে বিষয়ে সরেজমিন পলওয়েল মার্কেটের একাধিক দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে সেখানে নিয়ম মেনে পোশাক ও সরঞ্জামাদি বিক্রি হচ্ছে। একজন দোকানির কাছে একটি পিস্তলের হোলস্টার দরদাম করার আগেই দোকানির ভাষ্য 'স্যার লাইসেন্সটা আগে দেখান, এরপর দরদাম করেন। এতে করে আমাদের জন্য সুবিধা হবে। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনার বৈধ পিস্তল বা রিভলভারের লাইসেন্স না থাকলে আপনার কাছে হোলস্টার বিক্রি করা যাবে না। বিক্রি করে ধরা পড়লে লাইসেন্স বাতিল হবে।' এমনকি ব্যবসায়ী হিসাবে কালোতালিকাভুক্ত হওয়ার পাশাপাশি জেল-জরিমানাও হতে পারে।
একাধিক দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটি সময় অনেক পুলিশের পোশাক ও সরঞ্জাম বিক্রির ক্ষেত্রে যথেষ্ট ঢিলেঢালা ছিল। যে কারণে এক সময় অনেকেই পুলিশ পরিচয়ে নানা সরঞ্জাম কিনে নিতে পারতেন। ওইসব সরঞ্জাম ব্যবহার করে পুলিশ পরিচয়ে অনেক অপরাধও সংঘটিত হয়েছে। নিকট অতীতেও এমন বেশ কিছু অপরাধের ঘটনা ঘটেছে। এখন সামান্য পিস্তলের হোলস্টারও সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করার নূ্যনতম সুযোগ নেই। যার পিস্তলের লাইসেন্স আছে বা যেসব পুলিশ সদস্যের বৈধ পিস্তল আছে শুধু তাদের কাছেই আগ্নেয়াস্ত্রটি রাখার হোলস্টার বিক্রি করতে হয়। অন্যান্য সরঞ্জাম বিক্রির তো প্রশ্নই আসে না।
এ ব্যাপারে বিশিষ্ট নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল আব্দুর রশীদ যায়যায়দিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আসল বা নকল পোশাক ব্যবহার করে অপরাধ করার বিষয়টি আরও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অন্যথায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর থেকে মানুষের আস্থা দিনকে দিন কমে যাবে। যা দেশের সার্বিক নিরাপত্তা এবং দেশের উন্নয়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। দেশের স্বার্থের জন্যও ক্ষতিকর। এজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নকল পোশাক তৈরিকারকসহ নকল পোশাক ব্যবহার করে যারা অপরাধে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। যাতে করে অপরাধীরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে বা নকল পোশাক পরিধান করে অপরাধ করার সাহস না করে। যা দেশের সার্বিক উন্নয়নে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।