উভয় সংকটে বিএনপি
৬ দিনের নতুন কর্মসূচি
প্রকাশ | ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
যাযাদি রিপোর্ট
একের পর এক নির্বাচন ও আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম হতাশা কাজ করছে। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন ঘিরে আন্দোলন সফল না হলেও আন্তর্জাতিক পর্যায় থেকে ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ প্রয়োগের ঘটনা তাদের আশা দেখাচ্ছিল। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিদেশিরা কূটনীতিক ভাষায় নির্বাচনের সমালোচনা করার পাশাপাশি ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে কাজ করার বার্তা দেওয়ায় সেই আশা অনেকটা ফিকে হয়ে যায়। অন্যদিকে নেতৃত্ব সংকট, মামলা, জেল-জুলুমের শিকার হয়ে সাংগঠনিকভাবেও বিপর্যস্ত দলটি সরকারবিরোধী কঠোর কর্মসূচিও দিতে পারছে না। এমন উভয় সংকটের মধ্যে কর্মী ধরে রাখা ও দলীয় অস্তিত্বের স্বার্থে অনেকটা ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সাদামাটা কর্মসূচিতে যেতে বাধ্য হচ্ছে বিএনপি।
জানা গেছে, নির্বাচন ঘিরে রাজনীতিতে যে উত্তাপ ছিল তা এখন না থাকলেও স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরতে বেগ পেতে হচ্ছে বিএনপিকে। কারণ আন্দোলন করতে গিয়ে দলের অনেক দুর্বলতার বিষয় সামনে এসেছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপের আশায় উদাসীনতা এবং অপরিকল্পিত-সমন্বয়হীন আন্দোলনের বিষয়টি চিহ্নিত হয়েছে। এমন অবস্থা উত্তরণে তিনটি বিষয় দলে এখন সর্বোচ্চ প্রাধান্য পাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে, এক. দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও কারাবন্দি সিনিয়র নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মুক্তি। দুই. দল পুনর্গঠন। তিন. ফাঁকে ফাঁকে জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি পালন করা।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নির্বাচন ঠেকানোর আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পর নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে নির্বাচনের পর সরকারের ওপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞা বা জোরালো পদক্ষেপ আসবে বলে যে গুঞ্জন ছিল বাস্তবে তা এখনো দেখা যায়নি। এর বাইরে নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকারকে বিভিন্ন দেশের সমর্থন এবং সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চিঠি দিয়েছে। ফলে দলের নেতাকর্মীরা বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে গত বছরের ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনপির মহাসমাবেশ পন্ড হয়ে যাওয়ার পর সিনিয়র নেতাসহ অনেক নেতাকর্মী
গ্রেপ্তার হন। ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত সারাদেশে এক হাজার ১৮৪ মামলায় এক লাখ পাঁচ হাজার ৬৮৪ জনকে আসামি করা হয়। এ সময়ে ২৭ হাজার ৫১৪ জন গ্রেপ্তার হন। ৯ হাজার ৭০৪ জন আহত হন। নেতাকর্মীদের বিশাল একটি অংশের এমন বিপর্যস্ত অবস্থায় নির্বাচন-পরবর্তীতে শক্তিশালী আন্দোলনের কর্মসূচি দেওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। এ জন্য বিএনপি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে নিরীহ গোছের কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে ফেরার পরিকল্পনা করেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিএনপি আবারও ঘুরে দাঁড়াতে চায়। সংগঠন গতিশীল করতে গত বৃহস্পতিবার স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও শীর্ষ নেতারা এ নিয়ে আলোচনা করেছেন। বৈঠকে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি না দিয়ে বড় জমায়েতের কর্মসূচি দেওয়া যায় কিনা সে বিষয়টি আলোচনায় প্রাধান্য পায়। সমাবেশ-মিছিল করা সম্ভব না হলে লিফলেট বিতরণের কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নে পরের দিন শুক্রবার যৌথসভা করে দলটি। যৌথসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সালাহউদ্দিন আহমেদ, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীসহ সাংগঠনিক ও সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি এবং কেন্দ্রীয় অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা উপস্থিত ছিলেন। এই সভায় মধ্য সারির নেতারা এখনই বড় জমায়েতের কর্মসূচি সফল করা কঠিন বলে জানান। ফলশ্রম্নতিতে বাধ্য হয়ে গণসংযোগ-লিফলেট বিতরণের মতো নিরীহ কর্মসূচি দেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। রোববার চলমান এক দফা আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৬ দিনের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে আগামীকাল মঙ্গল ও পরের দিন বুধবার ঢাকাসহ দেশের সব মহানগরে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ। ১৬ ফেব্রম্নয়ারি শুক্রবার সারাদেশে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে শহীদ বাংলাদেশিদের স্মরণে বাদ জুমা দেশের সব মসজিদে দোয়া ও মাগফিরাত কামনা। এরপর ১৭ ফেব্রম্নয়ারি শনিবার সব জেলা শহরে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ। ১৮ ও ১৯ ফেব্রম্নয়ারি রবি ও সোমবার দেশের সব উপজেলা, থানা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ।
জানা যায়, জনসম্পৃক্ত নানা ইসু্য লিফলেটে সন্নিবেশিত করে তা সারাদেশে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি ঘটিয়ে বিতরণ করা হবে। এর বাইরে নেতাকর্মীদের এখন নতুন করে চাঙা করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। এছাড়া রমজানের আগে সংগঠন গতিশীল রাখতে থেমে থেমে কর্মসূচি থাকবে। রমজানেও ইফতার পার্টির মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক গতিশীলতা বাড়াতে নেওয়া হবে নানা উদ্যোগ।
সূত্র মতে, কেন্দ্রীয়ভাবে এখন যে উদ্যোগ বা কর্মসূচি নেওয়া হোক না কেন, তৃণমূলের সুর ভিন্ন। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ঢাকার বাইরে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীরা আন্দোলনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেশি। তৃণমূলে আওয়ামী লীগের হামলা-মামলা ও আক্রোশের শিকার হয়েছেন তারা। ফলে ভবিষ্যতে এই ধরনের আক্রোশ এড়াতে অনেকে কৌশলী হবেন। কেউ কেউ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বেন। সম্প্রতি বিএনপির কালো পতাকা মিছিলেও এই বিষয়টি চোখে পড়েছে দলের নীতিনির্ধারকদের। এমন অবস্থায় নেতাকর্মীদের রাজপথে ফেরানো কঠিন হবে এমন উপলব্ধি আছে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে।
এ বিষয়ে দলের সিনিয়র এক নেতা বলেন, দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকার কারণে তৃণমূলের অনেকের মধ্যে হতাশা এসেছে। তাদের মধ্যে আশা জাগাতে না পারলে ব্যাপকসংখ্যক নেতাকর্মী হারাতে হবে। এই বিষয়ের দিকে দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা দৃষ্টি দিতে শুরু করেছেন। এ জন্য একেবারে নিরীহ গোছের কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হওয়াদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য নানা পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
দলকে গতিশীল করতে করণীয় প্রসঙ্গে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, ভোট কেন্দ্রে না গিয়ে ৭ জানুয়ারির জনগণ বিএনপির পক্ষে রায় দিয়েছে। এই রায়কে সম্মান জানিয়ে ভোটাধিকার ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত বিএনপি কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। এজন্য শিগগিরই দলকে গতিশীল করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হবে।