দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির লাগাম টানতে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পর গত ছয় দিনের্ যাব ও পুলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে সবজিসহ বিভিন্ন পণ্যবাহী পরিবহণ থেকে অবৈধভাবে টাকা আদায়ের সময় অর্ধ সহস্রাধিক চাঁদাবাজকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেছে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে নগদ টাকা, রসিদ ও চাঁদা আদায়ের কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র। তবে এই বিপুলসংখ্যক চাঁদাবাজ গ্রেপ্তারের পরও পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে কোনো প্রভাব পড়েনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাজার উল্টো তেতে উঠেছে।
পণ্যবাহী পরিবহণের মালিক-চালক ও শ্রমিকরা জানান, সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনার পরর্ যাব-পুলিশের অভিযানে রাস্তাঘাটে চাঁদা তোলার কাজে নিয়োজিত দিনভিত্তিক মজুররাই শুধু ধরা পড়ছে। চাঁদাবাজ চক্রের গডফাদাররা বরাবরের মতো অধরাই রয়ে গেছে। এরই মধ্যে তারা অনেকেই কৌশল পাল্টে চাঁদাবাজির রেট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
বগুড়া থেকে সবজি নিয়ে ঢাকায় আসা একাধিক ট্রাকচালক ও হেলপারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধরপাকড় অভিযানের মধ্যেও সড়ক-মহাসড়কে পণ্যবাহী ট্রাকে আগের মতোই চাঁদাবাজি চলছে। আগে পথে পথে ট্রাক থামিয়ে চাঁদা আদায় করা হতো। মাঝে টোকেন বা কার্ড দিয়ে পুরো মাসের চাঁদা তুলে নেওয়া হতো। এখন কোথাও কোথাও সেই 'টোকেন প্রথা' বদলেছে। ওইসব পয়েন্টে এখন চাঁদাবাজি হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাসিক চুক্তির টাকা পরিশোধ করছেন ট্রাকমালিকরা। পুলিশ ট্রাক আটকানোর পর মুঠোফোন নম্বরে ফোন দিলেই ট্রাক ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে পণ্যবাহী পরিবহণের চাঁদাবাজদের ধরতে পুলিশে দায়িত্ব দেওয়া হলেও এ ক্ষেত্রে তারা কতটা নিষ্ঠার সঙ্গে তা পালন করবে তা নিয়ে ব্যবসায়ীরা অনেকেই সন্দিহান। তাদের অভিযোগ, পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজির সঙ্গে হাইওয়ে, থানা ও ফাঁড়ি পুলিশের সরাসরি সম্পৃক্ততা রয়েছে। কোথাও কোথাও তারা নিজেরাই এ চাঁদা আদায় করছে। কোথাও আবার এ কাজে শ্রমিক শ্রেণির মানুষ নিয়োগ দিয়েছে। এছাড়া
সরকারি দলের চাঁদাবাজ নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীদের সঙ্গে পুলিশের আঁতাত থাকারও অভিযোগ করেছেন অনেকে।
বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থান হাটের সবজির মোকাম থেকে শসা, মুলা, বরবটি, পটোল ও করলা নিয়ে শুক্রবার দিবাগত রাতে পুরান ঢাকার শ্যামবাজারে আসা ট্রাকচালক শাহাবউদ্দিন জানান, ২২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে এখনো ১১ পয়েন্টে চাঁদা দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে ৭টি স্পটে ডিজিটাল পদ্ধতিতে এবং ৪টি স্পটে রসিদ দিয়ে চাঁদাবাজরা চাঁদা নিচ্ছে। এর আগে ১৩টি পয়েন্টে চাঁদা দিতে হতো বলে জানান এই ট্রাকচালক।
বগুড়ার একই হাট থেকে ছেড়ে আসা সবজিবাহী আরেক ট্রাকের হেলপার সবুজ মিয়া জানান, সাভারের আগ পর্যন্ত ডিজিটাল পদ্ধতিতে ১৩শ' টাকা এবং সাভার থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত রসিদের বিপরীতে ৬৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে।
ওই ট্রাকে মাল নিয়ে আসা সবজি ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর দাবি, সোমবার থেকে চাঁদাবাজ ধরপাকড় অভিযান শুরুর পর সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি তেমন কমেনি। ফলে পরিবহণ ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ আগের মতোই রয়ে গেছে। তাই মহাস্থানহাট থেকে পাইকারিতে কেনা শসা, কাঁচামরিচ, বেগুন, করলা, বরবটি, পটোল, ঝিঙা ও পেঁপেসহ প্রতিটি সবজিই কেজিপ্রতি ৫/৭ টাকা বেশি দরে বিক্রি করতে হচ্ছে। চাঁদাবাজি বন্ধ হলে অনায়াসেই এই টাকা কমে তারা সবজি বিক্রি করতে পারতো।
বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির এক নেতার দাবি, দেশে প্রতিদিন ৯০ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক এবং কাভার্ডভ্যান চলাচল করে। এর কোনোটিই পুলিশকে চাঁদা না দিয়ে চলতে পারে না। সড়ক-মহাসড়কে ট্রাক চলাচল করতে গিয়ে একেকটি স্পটে ৫০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হয়। এই চাঁদা যেমন হাইওয়ে পুলিশ নেয়, তেমনি মালিক ও শ্রমিক সমিতির নামেও আদায় করা হয়। এছাড়া সরকারি দলের নেতাকর্মী ও সন্ত্রাসীরাও নিয়মিত চাঁদা নিচ্ছে।
চাল ব্যবসায়ী মাহতাব আলীর অভিযোগ, বগুড়া থেকে ঢাকায় আসতে একটি ট্রাককে এখনো অন্তত ১২ জায়গায় চাঁদা দিতে হচ্ছে। এগুলো নির্দিষ্ট চাঁদা। এর ওপর 'হঠাৎ' চাঁদাও রয়েছে। গড়ে একটি ট্রাককে কমপক্ষে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা চাঁদা গুনতে হয়।
বাজার পর্যবেক্ষকরা জানান, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, বিভিন্ন ফেরিঘাট, ওজন স্টেশন, বাজার কমিটি, পরিবহণ সংগঠন ও শ্রমিক ইউনিয়ন, ট্রাফিক পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ ও থানা-পুলিশের নামে এখনো তোলা হচ্ছে চাঁদা। গত কয়েকদিনের্ যাব-পুলিশের অভিযানে যারা ধরা পড়েছে তাদের একজনও চাঁদাবাজ চক্রের মূল হোতা নন। এদের সবাই চুনোপুঁটি। পুলিশ এদের ১০ জনকে ধরলে ওইদিনই আরও ১৫ জনকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। পুলিশ এক স্পটে অভিযান চালালে চাঁদাবাজরা অন্য স্পট বেছে নিচ্ছে। চাঁদাবাজ চক্রের রাঘব বোয়ালদের ধরতে হলে সরকারকে ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করতে হবে। অথচ চাঁদাবাজদের তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার পর প্রতিবারই প্রশাসন পুরনো পথেই হাঁটছে।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, পরিবহণ খাতে ব্যাপক চাঁদাবাজির ফলে কৃষকের জমি থেকে উঠে আসার পর জায়গায় জায়গায় হাতবদল হতে হতে ক্রেতার কাছে পৌঁছতেই ভোগ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে কয়েকগুণ। যার প্রভাব পড়ছে সরাসরি ভোক্তাদের ওপরই। এ নিয়ে সম্প্রতি প্রশাসনের তোড়জোড় শুরু হলেও কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
কুড়িগ্রাম, ভূরুঙ্গামারী, নরসিংদী ও সিলেটসহ দেশের প্রায় অর্ধডজন এলাকার কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার বাজারে প্রতিটি সবজি যে দরে বিক্রি হচ্ছে তারা এর এক-তৃতীয়াংশ দরেও স্থানীয় হাটে তা বিক্রি করতে পারছেন না। ফলে একদিকে ভোক্তাদের যেমন নাভিশ্বাস উঠছে, অন্যদিকে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এদিকে শুধু পণ্যবাহী পরিবহণেই চাঁদাবাজি হচ্ছে তা নয়, খোদ রাজধানীর প্রতিটি বাজার এবং বেশকিছু রাস্তাতেও এখনো নিয়মিত চাঁদাবাজি চলছে। রাজধানীর মালিবাগ বাজারে একজন ব্যবসায়ী জানান, কারওয়ান বাজার থেকে এক ভ্যান সবজি দোকান পর্যন্ত আনতে এখনো অন্তত দেড়শ' থেকে দুইশ' টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। এছাড়া বাজার থেকেও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন অজুহাতে নিয়মিত চাঁদা তুলছেন। এমনকি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ভ্যান সবজি বিক্রি করতে হলেও পুলিশ ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের চাঁদা দিতে হচ্ছে।
পুলিশের একজন সাবেক ডিআইজি এ প্রসঙ্গে বলেন, সড়ক-মহাসড়ক, বাজার কিংবা পাড়া-মহলস্না থেকে চাঁদা তোলা মজুর কিংবা লাইনম্যানদের গ্রেপ্তার করে চাঁদাবাজি বন্ধ করা যাবে না। তা নির্মূল করতে হলে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়ে চাঁদাবাজ চক্রের গডফাদারদের চিহ্নিত করতে হবে। পাশাপাশি গোপন অনুসন্ধান চালিয়ে চাঁদাবাজির সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা জরুরি। যাতে তাদের গ্রেপ্তার করে চাঁদাবাজির সুনির্দিষ্ট ধারায় মামলা করা যায়।
এছাড়া চাঁদাবাজির মামলায় গ্রেপ্তারকৃত গডফাদাররা যাতে আইনি ফাঁকফোকর গলে দ্রম্নত জামিনে বেরিয়ে আসতে না পারে এজন্য পুলিশকে সতর্ক থাকা জরুরি। শুধুমাত্র চুনোপুঁটিদের গ্রেপ্তার করে চাঁদাবাজি বন্ধ করা অসম্ভব বলে মন্তব্য করেন পুলিশের এই সাবেক কর্মকর্তা।
তার এ আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা গত কয়েকদিনের্ যাব ও পুলিশের টানা অভিযানের মধ্যেও চাঁদাবাজি চলমান থাকায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাঁদাবাজ চক্র তাদের কৌশল ও স্পট পরিবর্তন করেও চাঁদাবাজি অব্যাহত রেখেছে।র্ যাব ও পুলিশ যাদের গ্রেপ্তার করছে তাদের বেশিরভাগই নিম্নআয়ের মানুষ। মূল হোতারা চাঁদাবাজির টাকায় গাড়ি-বাড়ি করে আরাম-আয়েসে দিন কাটাচ্ছে। অথচ গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে তাদের চিহ্নিত করার তেমন উলেস্নখযোগ্য কোনো উদ্যোগ নেই।
তবের্ যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, চাঁদাবাজ চক্রের মূল হোতাদের ধরতে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। কৌশল পাল্টে কিংবা পর্দার আড়ালে থেকে তারা চাঁদাবাজি চালিয়ে যেতে পারবে না।