সীমান্তে গুলি ফের আতঙ্কে মানুষজন

প্রকাশ | ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

নাইক্ষ্যংছড়ি (বান্দরবান) প্রতিনিধি
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের হোয়াইক্যং বাজারের পর যে সীমান্ত রেখা রয়েছে, সেখানে শনিবার সকালে মিয়ানমার অংশে নতুন করে সংঘর্ষ শুরু হয়। বৃষ্টির মতো গুলি চলে অনেকক্ষণ। এতে চরম ভোগান্তিতে আছে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকার মানুষ। এ দিন মিয়ানমার থেকে গুলি এসে পড়েছে এপাড়ের অংশে। এদিকে, নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম ইউনিয়নের মিয়ানমার সীমান্তঘেঁষা পশ্চিমকূল এলাকায় 'অবিস্ফোরিত মর্টার শেল' উদ্ধার করা হয়েছে। গত তিন দিনে এই সীমান্ত এলাকার বসতবাড়ির উঠান ও ফসলের ক্ষেত থেকে এমন তিনটি অবিস্ফোরিত মর্টার শেল পাওয়া যায়। এ ছাড়া বসতঘর, উঠান, সড়ক ও বিলে পাওয়া যাচ্ছে গুলি ও গুলির খোসা। ফলে আতঙ্ক বিরাজ করছে স্থানীয়দের মধ্যে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়কের টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের হোয়াইক্যং বাজার থেকে আধা কিলোমিটার পূর্বে উত্তরপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায় লোকজনের জটলা। সবার চোখ-মুখে আতঙ্কের ছাপ। তারা বলাবলি করছেন, গুলির শব্দে তাদের ঘুম ভাঙে। এরপর ভোর ৫টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত চার ঘণ্টায় ওপার থেকে 'বৃষ্টির মতো' গুলি এসেছে। পুরোটা সময় কাটে তাদের আতঙ্কে। তবে তখনো ভয়ে-আতঙ্কে অনেকের হাত-পা কাঁপছিল। আতঙ্কিত মানুষগুলো জানান, গুলি এসে পড়েছে দোকান, মাছের ঘের ও বসতবাড়িতে। তবে কেউ হতাহত হননি। অনেকে বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন। উত্তরপাড়ার বাসিন্দা নূর হোসেন বলেন, গুলির শব্দে ঘুম ভেঙেছে তার। এরপর শুধু বৃষ্টির মতো গুলি এসেছে। এখন কী করবেন, বুঝতে পারছেন না। পরিবার নিয়ে অন্যত্র যাওয়ার প্রস্তুতি নেন তিনি। উত্তরপাড়ার মুদিদোকানদার নুরুল ইসলাম বলেন, তার দোকানের পেছনের দেয়ালে একটি গুলি লেগেছে। দেয়াল পাকা বলে গুলিটি ভেতরে ঢুকতে পারেনি। পরে প্রশাসনের লোকজন গুলিটি নিয়ে যায়। আবার কখন গুলি এসে পড়ে, সেই ভয়ে আছেন। স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ ইলিয়াসের একটি মাছের ঘের রয়েছে। তিনি বলেন, সকালে তার মাছের ঘেরে একটি গুলি এসে পড়তে দেখেন। তার পাশে মোহাম্মদ মানিকের ঘেরে অনেক গুলি পড়েছে। গুলি পড়েছে এক কিলোমিটার দূরেও শুধু সীমান্ত-লাগোয় উত্তরপাড়া নয়, সীমান্ত থেকে এক কিলোমিটার দূরে মাঝেরপাড়া এলাকায় মোহাম্মদ আফসারের ঘরে সকাল ৭টার দিকে জানালা দিয়ে একটি গুলি ঢুকে পড়ে। আফসার বলেন, তখন ঘরে সবাই ছিলেন। তবে কারও গায়ে গুলি লাগেনি। আফসারের ঘর থেকে ৫০০ গজ পূর্বে দলু মিয়ার ঘরেও জানালা দিয়ে একটি গুলি ভেতরে এসে পড়ে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য সিরাজুল মোস্তফা বলেন, 'সকালে বৃষ্টির মতো গুলির শব্দ শুনে ঘর থেকে একটু বের হই। আমার চোখের সামনে একটি গুলি উড়ে যায়। আজকে হয়ত আমার জানাজা পড়াতে হতো।' উত্তরপাড়ায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একটি ফাঁড়ি রয়েছে উলেস্নখ করে সিরাজুল মোস্তফা বলেন, বুধবার থেকে রাতে গোলাগুলি হলেও দিনে হতো না। কিন্তু শনিবার সকাল থেকে গোলাগুলি শুরু হওয়ায় এবং লোকজনের বসতবাড়িতে এসে পড়ায় সবাই চরম আতঙ্কে রয়েছে। তবে এ ঘটনার পর ওই এলাকায় বিজিবির সদস্যরা পাহারা জোরদার করেছেন এবং সতর্ক অবস্থায় আছেন। আরও একটি অবিস্ফোরিত মর্টারের গোলা উদ্বার! বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রম্ন এলাকা থেকে অক্ষত অবস্থায় মিয়ানমার থেকে ছোড়া অবিস্ফোরিত আরও একটি মর্টারের গোলা উদ্ধার করেছে বিজিবি। এ নিয়ে অক্ষত অবস্থায় দুটি মর্টার শেল উদ্ধার করে তুমব্রম্ন সড়কের পাশে নিরাপদ স্থানে রেখেছে তুমব্রম্ন বিওপির সদস্যরা। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় তুমব্রম্ন-ঘুমধুম সড়কের ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা হতে অক্ষত অবস্থায় এই মর্টারের অবিস্ফোরিত গোলাটি উদ্ধার করা হয়। বিজিবি ও স্থানীয়রা জানান, সকালে ব্রিজের পাশে অবিস্ফোরিত মর্টার শেলটি দেখেন পথচারী ও এলাকাবাসী। পরে বিজিবিকে খবর দিলে মর্টার শেলটি উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে রাখা হয়। এ নিয়ে মোট তিনটি মর্টার শেলের অবিস্ফোরিত গোলা উদ্বার হয়েছে। উদ্ধার হওয়া মর্টার শেলের গোলাটি নিরাপদ স্থানে রেখেছে তুমব্রম্ন বিওপির সদস্যরা। তবে কখন বিস্ফোরণ করা হবে, সেটির ব্যাপারে এখনো জানা যায়নি। দুই নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টো বলেন, সকালে ব্রিজ-সংলগ্ন এলাকায় মর্টার শেলটি দেখে বিজিবিকে খবর দেয়। পরে সেই বোমা উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে গেছে। উলেস্নখ্য, গতকাল তুমব্রম্ন সীমান্তের ৩৪ পিলার পাশে এক জমি থেকে অবিস্ফোরিত মর্টার শেল উদ্ধার করে বিজিবি। এ নিয়ে মোট তিনটি মর্টারের অবিস্ফোরিত মর্টার শেলের গোলা উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি গত শুক্রবার সকালে সেনা বোমা বিশেষজ্ঞ দল ধ্বংস করে দেয়। এ ছাড়া সীমান্তের তুমব্রম্ন, ঘুমধুম এলাকায় পরিস্থিতি ভালো। কিন্তু শুক্রবার গভীর রাতে মিয়ানমারের অভ্যন্তর থেকে থেমে থেম গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়। ২ ফেব্রম্নয়ারি রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির সংঘর্ষ চলছে। এরই মধ্যে বিজিপিকে হটিয়ে তুমব্রম্ন রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্ত চৌকি আরাকান আর্মি দখলে নিয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। রোববার রাত ৩টা থেকে দুইপক্ষের মধ্যে থেমে থেমে গোলাগুলি ও মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। পরদিন সোমবার নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নের জলপাইতলী গ্রামের একটি রান্নাঘরের ওপর মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টার শেলের আঘাতে দুইজন নিহত হন। নিহত দুইজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশি নারী, অন্যজন রোহিঙ্গা পুরুষ। এ ছাড়া মিয়ানমার সেনা, সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য, শুল্ক কর্মকর্তাসহ ৩৩০ জন বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। তারা বর্তমানে বিজিবি হেফাজতে রয়েছেন। আকাশ কিংবা নদীপথে তাদের সে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা চলছে।