সপ্তাহখানিক আগে হঠাৎ অশান্ত হয়ে ওঠা মিয়ানমারের সঙ্গে বান্দরবান ও কক্সবাজার সীমান্ত এখন অনেকটাই শান্ত। ফলে বাড়ি-ঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়া স্থানীয়রা অনেকে আবার ফিরেও এসেছেন। কয়েক দিন ধরে ফেলে রাখা কাজ-বাজের কারণে তাদের ঘরে ফেরার তাড়া, অজানা আতঙ্ক নিয়েই গৃহস্থালি ও কৃষি কাজ সামলাচ্ছেন পরিবারের বড়রা। স্থানীয়রা বলছেন, গত সপ্তাহে যেমন তীব্র গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছিল, এখন তেমনটি নেই। তবে মাঝেমধ্যেই মিয়ানমার থেকে আসছে গোলা কিংবা গুলির শব্দ।
এদিকে, বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্ত থেকে উদ্ধার করা মর্টার শেলের নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে বিজিবি ও সেনাবাহিনী। ওই বিস্ফোরণের শব্দের পর সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারে কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা গেছে। অন্যদিকে, উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্তে অজ্ঞাত একজনের মরদেহ পড়ে থাকার খবর পেয়েছে বিজিবি। তবে সংঘাতপূর্ণ ওই এলাকায় গিয়ে মরদেহটি উদ্ধার করা কঠিন বলে দাবি করেছেন তারা।
নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রম্ন ইউনিয়ন পরিষদের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, 'গত রবি-সোম ও মঙ্গলবার যে মাত্রায় গোলাগুলি হয়েছে, বুধবার থেকে সেরকম শব্দ শোনা যাচ্ছে না। তবে মাঝে মাঝেই হঠাৎ হঠাৎ গুলির শব্দ কিংবা ভারী গোলা বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া যায়।'
তার ভাষ্য- 'শুক্রবার বেলা ১১টার দিকেও সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের ঢেকি বুনিয়া থেকে ভারী গোলা বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দ শুনেছেন এলাকার লোকজন। নিজেদের অবস্থান জানান দিতেই হয়তো সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীদের ক্যাম্পগুলোর দখলকারীরা এমন আওয়াজ করছে।' তুমব্রম্নর বাসিন্দারা বলছেন, মিয়ানমার সীমান্তের 'লেফট ক্যাম্প ও রাইট ক্যাম্প' নামে দুটি বড় স্থাপনা পুনঃদখলে নিতে জান্তা বাহিনী পাল্টা হামলা চালাতে পারে। ফলে সেই আতঙ্কও রয়েছে তাদের মনে।
বৃহস্পতিবার রাতেও টেকনাফ সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন। হোয়াইক্যং, হ্নীলা এলাকার গ্রামগুলোর মানুষেরা এখনো নিজেদের বাড়িতেই অবস্থান করছেন।
উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্ত এলাকাতেও থেমে থেমে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে। শুক্রবার ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত উখিয়ার থাইংখালী রহমতের বিল সীমান্তের ওপার থেকে গুলির শব্দ এসেছে বলে জানান স্থানীয় মোহাম্মদ আলী।
তিনি বলেন, 'বৃহস্পতিবার কিছুটা গুলির শব্দ কম শোনা গেলেও শুক্রবার ভোর থেকে ওপারে পুনরায় চলছে গোলাগুলি। এপার থেকেই সেই শব্দ শোনা যাচ্ছে।'
সীমান্তের ওপারে মিয়ানমার থেকে মাঝেমধ্যেই গোলা এসে পড়েছে এপারের বাড়িঘরে। যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে রোববার দিনভর মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী-বিজিপির সশস্ত্র সদস্যের অনুপ্রবেশ চাঞ্চল্য ছড়ায়। এরপর কয়েকদিনে বিজিপি সদস্যসহ মিয়ানমার থেকে মোট এসেছেন ৩৩০ জন।
মিয়ানমারের বিদ্রোহী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে দেশটির জান্তা বাহিনীর লড়াই চলছে। তা'আং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি-টিএনএলএ, আরাকান আর্মি-এএ এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স আর্মি-এমএনডিএএ মিলে জোট গঠন করে আক্রমণ চালাচ্ছে। তারা শান, রাখাইন, চীন ও কেয়াহ রাজ্যে লড়াই করছে। বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ও সেনাপোস্ট দখল করে ইতোমধ্যে তারা সাফল্য দেখিয়েছে।
জোটের অন্যতম অংশ আরাকান আর্মি মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য রাখাইনের সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠীর একটি সশস্ত্র বাহিনী। তারা রাখাইনের বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে লড়াই করছে। এ রাজ্যটিই বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে। সেখানে সেনা ও বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াইয়ের প্রভাব পড়ছে সীমান্তের এপারের জনগোষ্ঠীর মধ্যে।
ওপারের যুদ্ধে এপারে ছুটে আসা গুলিতে দুই বাংলাদেশির প্রাণ গেছে; আহত হয়েছেন কয়েকজন। সীমান্তের এপারে কারো কারো ঘরবাড়িতে এসে পড়ছে গোলা।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার ভোর ৫টা পর্যন্ত সীমান্তের কাছাকাছি এলাকা গোলাগুলি আর মর্টার শেল বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কেঁপে উঠেছে দাবি করে টেকনাফ উপজেলার হোয়াইক্ষ্যং উনছিপ্রাং সীমান্তের স্থানীয়রা বলছেন, ওপারে ঢেঁকিবুনিয়া এলাকায় মিয়ানমার সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ঘাঁটিগুলো দখল করে দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি ও অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। এই কারণে টেকনাফ অংশে মিয়ানমারের শহর শীলখালী, বলিবাজার ও কুইরখালী থেকে এসব বিস্ফোরণের শব্দ আসছে।
উনছিপ্রাং স্থানীয় বাসিন্দা কামরুল ইসলাম বলেন, 'আজ ভোর ৫টা পর্যন্ত সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় ভারী অস্ত্রের বিকট শব্দ শুনতে পেয়েছি। এই শব্দে এলাকা কেঁপে উঠছে। মনে হচ্ছে বজ্রপাত হচ্ছে। এরকম শব্দ জন্মের পরও শুনিনি।'
আরেক বাসিন্দা বসত করিম বলেন, 'আমি চিংড়ি চাষি। মিয়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি বাংলাদেশ অংশে মাস্টারের প্যারা এলাকায় আমার চিংড়ি ঘের। মিয়ানমারে কী হচ্ছে হচ্ছে না সেটি খালি চোখে দেখা যায়। বিকালের দিকে কালো পোশাক পরা মানুষের সঙ্গে মিয়ানমারের নাসাকা (বিজিপি) সঙ্গে গুলি বিনিময় হচ্ছে। কিছু মানুষ আমাদের সীমান্তে বিলার দ্বীপের দিকে আশ্রয় নিয়েছে। লাগাতার বোমা হামলা হচ্ছে। বোমার বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠছে এপার।'
হোয়াইক্ষ্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ আনুয়ারী বলেন, 'উনছিপ্রাং, কানজড়পাড়া, খারাংখালী ঝিমনখালী এলাকায় ভারী অস্ত্রের বিকট শব্দ শোনা যায়। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে সীমান্তের কাছাকাছি থাকা চিংড়ি চাষিরা। কয়েক দিন আগেও বসতঘরে গুলি এসে পড়ে। অল্পের জন্য জীবন রক্ষা পায়। শোনা যাচ্ছে শীলখালী, বলিবাজার ও কুইরখালী ঘাঁটি দখল নিতে বিদ্রোহীরা হামলা করছে।'
মর্টার সেলের নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ
ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা থেকে উদ্ধার মর্টার শেলটি বান্দরবানের ঘুমধুম নয়াপাড়া সীমান্ত এলাকায় শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে সেনাবাহিনীর বোমা নিষ্ক্রিকরণ দল। এ সময় বিজেবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
রহমতের বিল সীমান্তে লাশ
উখিয়া থানার ওসি মো. শামীম হোসেন বলেন, 'উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্তে অজ্ঞাত একজনের মরদেহ পড়ে থাকার খবর পাওয়া গেছে। তবে সংঘাতপূর্ণ ওই এলাকায় গিয়ে আমরা এখনো লাশটি উদ্ধার করতে পারিনি। খবরটি বিজিবিকে দেওয়া হয়েছে। বিজিবির আনুষ্ঠানিক অনুমতি পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিপি), মিয়ানমার সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইমিগ্রেশন সদস্য ও অন্যান্য সংস্থার ৩ শতাধিক সদস্য বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) তাদের সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ করে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে এবং আহতদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে।