রোববার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১
নিষিদ্ধের ২২ বছরেও বন্ধ হয়নি পলিথিন

পলিথিন দূষণ বন্ধ করাই চ্যালেঞ্জ

আলতাব হোসেন
  ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
পলিথিন দূষণ বন্ধ করাই চ্যালেঞ্জ

পস্নাস্টিক বর্জ্যে সয়লাব চার পাশ। ঘরে পলিথিন বা পস্ন্যাস্টিকের পণ্য নেই, দেশে এমন একটি ঘরও খুঁজে পাওয়া যাবে না। মানুষের অসচেতনতায় ভয়ংকর পরিণতির পথে এগোচ্ছে জীবন, প্রকৃতি ও পরিবেশ। দেশে প্রতিদিন ৩ হাজার টন পস্নাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়। ঢাকায় একবার ব্যবহারের পর ৮০ শতাংশ মাটিতে ফেলা হচ্ছে। ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া পস্নাস্টিক ১ হাজার বছরেও মাটির সঙ্গে মিশে না। ফলে পস্ন্যাস্টিক-পলিথিন দূষণের কারণে মাটির উর্বরাশক্তি কমছে। এতে ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।

মাটি হচ্ছে কৃষির মূল ভিত্তি। উর্বর মাটি না হলে ভালো ফসল পাওয়া যায় না। পস্নাস্টিক ও পলিথিন দূষণে মোট আবাদি জমির ৬৯ ভাগেই মারাত্মক জৈব ঘাটতি তৈরি হয়েছে। মাটিতেই ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকার কথা থাকলেও তা এক শতাংশেরও নিচে নেমে গেছে। সাধারণত ৪৫ শতাংশ খনিজ বা মাটির কণা, ৫ শতাংশ জৈব এবং ২৫ শতাংশ করে পানি ও বাতাস থাকা মাটিকে সুষম মাটি বলা হয়। একটি আদর্শ জমিতে জৈব পদার্থের মাত্রা ৩ দশমিক ৫ শতাংশ থাকা অতি প্রয়োজনীয় হলেও

দেশের বেশির ভাগ জমিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ ১ দশমিক ১৭ শতাংশ এবং কিছু কিছু জমিতে এর পরিমাণ ১ শতাংশের চেয়েও কম? এর মধ্যে ৫৪ লাখ হেক্টর জমিতে ফসফরাস, ২৬ দশমিক ৩০ লাখ হেক্টর জমিতে পটাশিয়াম, ৩৩ দশমিক ৩০ লাখ আট হাজার হেক্টর জমিতে গন্ধক, ২৭ দশমিক ৭ লাখ হেক্টর জমিতে দস্তা সার, ২৩ দশমিক ৯ লাখ হেক্টর জমিতে বোরন সারের অভাব রয়েছে? এছাড়া অনেক জমিতে ক্যালসিয়াম ও ম্যাগনেসিয়ামের অভাব বাড়ছে।

এদিকে গত ৫ ডিসেম্বর, বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস পালিত হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য ছিল 'মাটি ও পানি :জীবনের উৎস'। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য করে রেখে যাওয়ার অঙ্গীকারের প্রেক্ষাপটে মাটি ও পানির গুরুত্ব অপরিসীম। খাদ্যের শতকরা ৯৫ ভাগ উৎপাদিত হয় ভূমিতে, যেখানে মাটি ও পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। অথচ পলিথিন ও পস্ন্যাস্টিক বর্জ্যে মাটি ও পানির ক্ষতি হচ্ছে ভয়াবহ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) তথ্য বলছে, দেশজুড়ে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির প্রায় ১ হাজার ২০০ কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পুরান ঢাকার অলিগলিতে রয়েছে অন্তত ৩০০ কারখানা।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আসহান এম কামাল জানান, পস্ন্যাস্টিকের জীবনচক্রের প্রথম ধাপ শুরু হয়ে জীবাশ্ম জালানি, অপরিশোধিত তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস নিষ্কাশনের মধ্য দিয়ে। এই অনবায়নযোগ্য শক্তি উৎসগুলোকে পস্ন্যাস্টিক উৎপাদনের কাঁচামাল, যেমন-ইথিলিন ও প্রোপিলিন পেতে ব্যবহার করা হয়। এই নিষ্কাশন প্রক্রিয়ার ফলে বায়ু, মাটি, পানি দূষণ হয় এবং এর ফলে নির্গত গ্রিনহাউজ গ্যাসের কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিপর্যয়ের ঘটনা দ্রম্নত ঘটছে। দেশে প্রতিদিন প্রায় চার হাজার টন পস্ন্যাস্টিক বর্জ্য পোড়ানো হয়, যা ব্যাপকভাবে বায়ুদূষণ করছে। এ ছাড়াও ফেলে দেওয়া পস্ন্যাস্টিক থেকে টাইলস, মেলামাইননের গস্নাস-পেস্নটসহ নানা ধরনের বিষাক্ত পণ্য তৈরি হচ্ছে। শুধু ঢাকায় নয়, দেশের সর্বত্রই এখন মাইক্রোপস্ন্যাস্টিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এর ছোট ছোট বস্তুকণাগুলো খাদ্যের সঙ্গে মিশে আমাদের দেহে প্রবেশ করে এবং বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করছে।

২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষে পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ৩ হাজার কারখানায় প্রতিদিন ১ কোটি ৪০ লাখ পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন হচ্ছে। গত ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে মাথাপিছু পস্ন্যাস্টিক পণ্যের ব্যবহার ৩ কেজি থেকে বেড়ে ৯ কেজি হয়েছে। এই পস্ন্যাস্টিক ও পলিথিনের একটি বড় অংশই মাটিতে এবং খাল ও নদীতে গিয়ে পড়ছে। এতে শিশুদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ মায়ের দুধেও পস্ন্যাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া নদ-নদীর মাছ, চিনি, লবণ ও পানিতেও পাওয়া গেছে ক্ষতিকর পস্ন্যাস্টিক।

পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন প্রায় ৯৪ হাজার টন পস্নাস্টিক পণ্য এবং ১ কোটি ৪৮ লাখ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার হয়। ব্যবহারের পর ফেলে দেওয়া এসব পস্নাস্টিক বর্জ্য অলিগলি, নর্দমা, ড্রেন হয়ে পড়ছে জলাভূমিতে। পরে জলাভূমির মাছের মাধ্যমে দূষিত পস্নাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মানবদেহে প্রবেশ করছে। জাতিসংঘের তথ্যমতে, বিশ্বে প্রতি বছর ৫০ হাজার কোটি পস্নাস্টিক ব্যাগ, ৪৮ হাজার কোটি পানীয় বোতল উৎপন্ন হয় এবং প্রতি মিনিটে ১০ লাখ পস্নাস্টিক বোতল বিক্রি হয়। এসব পস্নাস্টিকের শেষ গন্তব্য হয় মাটির নিচে ও সাগর তলে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা নদী হয়ে বছরে প্রায় ৭৩ হাজার টন পস্নাস্টিক বর্জ্য বঙ্গোপসাগরে গিয়ে জমা হচ্ছে। এতে বিপর্যস্ত হচ্ছে সামুদ্রিক জীবন। আবার পলিথিন ও পস্ন্যস্টিক বর্জ্য পুড়িয়ে ফেলার ফলে পরিবেশে বিভিন্ন রকম বিষাক্ত পদার্থ মিশে যায়, যার ফলে বায়ুদূষণ ঘটে। ঢাকার বায়ু দূষণের মাত্রা বৃদ্ধিতে পস্ন্যাস্টিক ও পলিথিন দূষণের দায় রয়েছে। বায়ু দূষণের কারণে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগব্যাধির মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

বাংলাদেশ নেচার কনজার্ভেশন ম্যানেজমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. এস এম মনজুরুল হান্নান খান যায়যায়দিনকে বলেন, ঢাকার প্রতিদিনের পস্নাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ ৭৮৪ টন। রাজধানীর চারপাশের চারটি (বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা) নদীতে প্রায় প্রতিদিন ৩০ হাজার টন পস্নাস্টিক বর্জ্য পাওয়া যাচ্ছে, যার অর্ধেকই পাওয়া গেছে বুড়িগঙ্গায়। কক্সবাজারে পর্যটন মৌসুমে প্রতিদিন ১৩০ টন আর্বজনা হয়, যার ৩০ শতাংশ পস্নস্টিক, যার আবার ৮৪ শতাংশই একবার ব্যবহারযোগ্য পস্নস্টিক। বঙ্গোপসাগরে মাছের পেটে এবং লবণের মধ্যে ক্ষুদ্র পস্নাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। পস্নাস্টিক বর্জ্যের দূষণে মানুষের লিঙ্গ পরিবর্তন হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে প্রজননশীলতা কমে যাচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে হরমোনের ভারসাম্য। এমনকি ক্যানসার হচ্ছে। শুধু পস্নাস্টিক বর্জ্যের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা যাচ্ছে। এতে ভারসাম্য হারাচ্ছে সামুদ্রিক পরিবেশ। যা প্রাণিকূল ছাড়াও মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। বাংলাদেশে পস্নাস্টিক দূষণকারীদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে কোমল পানীয় প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

এ বিষয়ে পরিবেশবিদ ড. সুমেন্দ্র দেবনাথ বলেন, পস্নাস্টিক পণ্য সুন্দর ও নমনীয় রাখতে থ্যালেট নামে কেমিক্যাল পদার্থ ব্যবহার করা হয়। এই ক্ষতিকর থ্যালেট পস্নাস্টিক সামগ্রী থেকে খাদ্যে বা পানিতে মিশে যায়। থ্যালেট সিন্থেটিক ইস্টোজেন হিসেবেও কাজ করে। থ্যালেটের কারণে প্রাণীর শরীরে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে প্রজননশীলতা কমে যায়। এমনকি ক্যানসার হচ্ছে। শুধু পস্নাস্টিক বর্জ্যের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা যাচ্ছে। এভাবে বিপন্ন প্রজাতির মাছ বা সামুদ্রিক প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটছে। এই প্রবণতা বৃদ্ধি পেলে ২০৫০ সালের মধ্যে ৯৫ শতাংশ জলজ ও মাটির নিচে থাকা প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে। যার মধ্যে মাছ, শামুক, তিমি, ডলফিন, কুমির ইত্যাদি রয়েছে। এমন অবস্থাকে মহাবিপর্যয়ের অশনিসংকেত দেখছেন বিজ্ঞানীরা।

এ দিকে শহর ও গ্রামীণ জীবনে পস্নাস্টিকের ব্যবহার বাড়ছে। দামে সস্তা ও সহজে বহনযোগ্য হওয়ায় এ পণ্যের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। বাজারের ব্যাগ থেকে শুরু করে ওষুধের বোতল, প্রসাধন সামগ্রীর মোড়ক, পানির বোতল, গৃহস্থালিসহ নানা কাজে এবং বাণিজ্যিকভাবে পস্নাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে। প্রতিদিনের কেনাকাটায় কাঁচাবাজার বা মোড়ের দোকান যেখানেই যান, পণ্য বহনে পলিথিন ব্যাগ দেওয়া হয়। ঘরে আসার পর এসব পলিথিন ব্যাগ বা পস্নাস্টিক বোতল আবার অন্য কাজেও ব্যবহৃত হয়। রান্নাঘরের ময়লা রাখার সহজ উপাদান এখন পলিথিন।

এ বিষয়ে শিশু বিশেষজ্ঞ ড. সেলিমুজ্জান ভূঁইয়া বলেন, কিছু পস্নাস্টিক পণ্য এমন কিছু উপাদান দিয়ে তৈরি, যার মধ্যে ক্যানসারের ঝুঁকি রয়েছে। এর মধ্যে পস্নাস্টিকের খেলনাগুলো বেশি বিপজ্জনক। ছোট শিশুরা নরম ও স্থিতিস্থাপক খেলনা পেলেই মুখে দিয়ে থাকে। এই অভ্যাস সবার অগোচরে শিশুর স্বাস্থ্যের জন্য বিপদ ডেকে আনে। হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে শিশুটি অসুস্থ হয় না। কিন্তু বিষাক্ত উপাদানের ক্ষতিকর প্রভাবে কোনো এক সময় ওই শিশুর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে ত্রম্নটি দেখা দিতে পারে। এতে প্রাণঘাতী নানা রোগ ও ছেলেমেয়েদের মধ্যে আগাম বয়ঃসন্ধির ঘটনা ঘটে থাকে।

বাংলাদেশে ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর পরিপ্রেক্ষিতে পলিথিনের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন এবং পরিবহণ নিষিদ্ধ করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। সেই সঙ্গে পলিথিন বাজারজাত করলে ছয় মাসের জেলসহ ১০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়। ২০০২ সালের পর তিন-চার বছর পলিথিন ব্যবহার সীমিত হলেও বর্তমানে যত্রতত্র অবাধে ব্যবহার হচ্ছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে শপিংমলে অবাধে চলছে ব্যবহার।

বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালে ধান, চাল, ভুট্টা, সার, চিনিসহ ১৯টি পণ্যের মোড়ক হিসেবে পস্ন্যাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। তখন কিছু অভিযানও চালানো হয়। পরে সেই উদ্যোগের আর সুফল মেলেনি। আণবিক শক্তি কমিশনের সাবেক মহাপরিচালক মোবারক আহমদ খান ২০১৬ সালে 'সোনালি ব্যাগ' উদ্ভাবন করেন। তার এ আবিষ্কার ব্যাপক সাড়া ফেলায় ব্যাগটি বাজারজাত করতে ২০১৮ সালে একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প নেওয়া হয়। তবে প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আনা যায়নি সোনালি ব্যাগ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে