নিত্যপণ্যের দাম কমাতে সরকার চাঁদাবাজ ও সিন্ডিকেট কারবারিদের গ্রেপ্তারে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে। চলমান অভিযানে পাঁচ দিনের্ যাব ১৯৬ জন চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা সবজি ও নিত্যপণ্যবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজি করত। গ্রেপ্তারদের কাছে পাওয়া গেছে চাঁদাবাজির নগদ টাকাসহ নানা সরঞ্জাম। এদিকে চাঁদাবাজ গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চললেও নিত্যপণ্যের দাম আশাতীত হারে কমেনি।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে অস্বাভাবিক হারে সবজিসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় জনমনে রীতিমতো অসন্তোষ বিরাজ করছে। তবে পাইকারি ও খুচরা বাজারে দামের ব্যাপক পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। পণ্যবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের কারণ ছাড়া নানা কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে বলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেয়।
তারই পরিপ্রেক্ষিতে নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সংশ্লিষ্টদের কড়া নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার নেপথ্যে সিন্ডিকেট কারবারি ও চাঁদাবাজদের গ্রেপ্তারের নির্দেশনা জারি করেন। এমনকি সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতরা সরকারদলীয় হলেও তাদের বিরুদ্ধেও আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
র্
যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন যায়যায়দিনকে বলেন, নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনতে পরিবহণ সেক্টরের বিশেষ করে সবজি ও নিত্যপণ্যবাহী যানবাহনে
চাঁদাবাজিতে জড়িতদের গ্রেপ্তারে সাঁড়াশি অভিযান চলছে। এমনকি নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে না আসা পর্যন্ত অভিযান অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে ভোক্তা অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে রয়েছেন।
তিনি আরও বলেন, নিত্যপণ্য নিয়ে সিন্ডিকেট করা ব্যবসায়ীদেরও গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে। সিন্ডিকেটের সদস্যদের পদ-পদবি কিছুই দেখা হবে না। সিন্ডিকেটের কোনো সদস্য যদি সরকারি দলের লোকও হয়, সেক্ষেত্রে ছাড় না দিতে সরকারের কড়া নির্দেশনা রয়েছে। শুধু তাই নয়, সিন্ডিকেট করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা বা দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানোর সঙ্গেও যারাই জড়িত থাকবে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হবে। পুরো বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের একাধিক সংস্থা মাঠে রয়েছে। বাড়ানো হয়েছে গোয়েন্দা নজরদারি। বিশেষ করে পবিত্র রমজান মাস শুরুর আগেই নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনার চেষ্টা চলছে নানাভাবে।
পরিবহণ সেক্টরে চাঁদাবাজির বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উলস্নাহ যায়যায়দিনকে বলেন, সারা দেশেই পরিবহণ সেক্টরে চাঁদাবাজির অভিযোগ আছে এবং সেই অভিযোগ সত্য। এমনকি পরিবহণ সেক্টরের বিভিন্ন সমিতি বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এসব সমিতি বা প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন পরিবহণের সেক্টরের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। তারা পরিবহণ সেক্টরের নামে চাঁদাবাজি করছে। প্রকৃতপক্ষে এমন চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতরা পরিবহণ সেক্টরের কেউ নয়।
তিনি আরও বলেন,্ এসব চাঁদাবাজদের হাত থেকে আমরা মুক্তি চাই। চাঁদাবাজদের কারণে পরিবহণ সেক্টরের দূর্নাম হচ্ছে। পুরো পরিবহণ সেক্টরকে কুলষিত করেছে চাঁদাবাজরা। পরিবহণ সমিতির নামে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি করার নূ্যনতম সুযোগ নেই। চাঁদাবাজদের কারণে অতিষ্ঠ পরিবহণ মালিক ও শ্রমিকরা। নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পরিবহণ সেক্টরের চাঁদাবাজি বন্ধে সরকারের আরও কঠোর হওয়া দরকার। তাহলে দ্রব্যমূল্যের দাম যেমন কমবে, তেমনি পরিবহণ খাত সংশ্লিষ্টরাও রেহাই পাবেন চাঁদাবাজদের হাত থেকে।
পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব আরও বলেন, সমিতির তরফ থেকে প্রতিটি যানবাহনের শ্রমিকদের কোন ধরণের চাঁদা না দিতে বলা হয়েছে। এমনকি পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের চাঁদা না দিতে রীতিমতো অনুরোধ পর্যন্ত করা হয়েছে। কেউ চাঁদা চাইলে সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে বলা হয়েছে পরিবহণ সংশ্লিষ্টদের।
প্রসঙ্গত,র্ যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক জানান কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছেন সরকারের নির্দেশনার পর থেকেই অভিযান অব্যাহত আছে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৩ ফেব্রম্নয়ারি রাতের্ যাব-২ ওর্ যাব-৩ সম্মিলিতভাবে ঢাকার কারওয়ান বাজার, বাবুবাজার, গুলিস্তান, দৈনিক বাংলা মোড়, ইত্তেফাক মোড়, মতিঝিল টিটিপাড়া, যাত্রাবাড়ীর কাজলা, গাবতলী ও ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টারসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানে সবজি ও পণ্যবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে ৫১ জনকে চাঁদাবাজ গ্রেপ্তার হয়। তাদের কাছে পাওয়া গেছে চাঁদা হিসাবে আদায় করা ১ লাখ সাড়ে ১২ হাজার টাকা। গাড়ি থামানোর কাজে ব্যবহৃত লেজার রশ্মির লাইট, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের জ্যাকেট, পরিচয়পত্র ও চাঁদা আদায়ের রশিদ।
তিনি আরও জানান, গত ৪ ফেব্রম্নয়ারি দিবাগত রাতের্ যাব-১০ ঢাকার কদমতলী থানাধীন শ্যামপুর চিপস ফ্যাক্টরি এলাকা থেকে আন্তঃজেলা ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লরি ও সিএনজিসহ বিভিন্ন পরিবহণে চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে ৬ চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করে। একই দিনর্ যাব-২ এর অভিযানে ঢাকার গাবতলী ও কারওয়ান বাজারে সবজি ও পণ্যবাহী ট্রাকে চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছে ১২ চাঁদাবাজ। তাদের কাছে পাওয়া গেছে চাঁদাবাজির প্রায় ১৯ হাজার টাকা ও বিভিন্ন সরঞ্জাম।
পরদিন ৫ ফেব্রম্নয়ারি দিবাগত রাতে ঢাকার শ্যামপুর থানাধীন বালুরমাঠ এলাকা থেকে পণ্যবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজির সময়র্ যাব-১০ এর সদস্যরা হাতেনাতে গ্রেপ্তার করে ৮ চাঁদাবাজকে। পরদিন ৬ ফেব্রম্নয়ারি ভোরের্ যাব-১০ ঢাকার যাত্রাবাড়ীর নিউ থ্রি স্টার ফল মার্কেটের সামনে চাঁদাবাজির সময় আন্তঃজেলা ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, লরি ও সিএনজিসহ বিভিন্ন পরিবহণে চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে আরও ৮ চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করে। তাদের কাছে পাওয়া যায় চাঁদা হিসেবে আদায় করা প্রায় ১৮ হাজার টাকা।
একই দিন নারায়ণগঞ্জে পরিবহণ সেক্টরের ২৫ চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করের্ যাব-১১। তাদের কাছে চাঁদাবাজি করতে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম পাওয়া গেছে। গ্রেপ্তারদের মধ্যে তাৎক্ষণিকভাবে ১৩ জনকের্ যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত কারাগারে পাঠিয়ে দেন। বাকি ১২ জনের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করা হয়।
গত ৭ ফেব্রম্নয়ারি সড়কে লাঠি হাতে পরিবহণে চাঁদাবাজি করার সময় ময়মনসিংহ থেকে ৫০ চাঁদাবাজকে গ্রেপ্তার করের্ যাব-১৪। গ্রেপ্তাররা নগরীর রহমতপুর বাইপাস মোড়, পাটগুদাম ব্রিজ মোড়, শম্ভুগঞ্জ, মুক্তাগাছা ও তারাকান্দার কাশিগঞ্জ এলাকায় চাঁদাবাজিকালে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়। তাদের কাছে পাওয়া গেছে চাঁদা তোলার রসিদ বই, চাঁদা হিসাবে আদায় করা ৬৫ হাজার টাকা ও যানবাহন থামানো এবং চালকদের ভয়ভীতি দেখানোর কাজে ব্যবহৃত লাঠি।
র্
যাব জানায়, বিভাগীয় শহরটিতে প্রায় ২০ হাজার বাস, ট্রাক, অটোরিকশা ও মাহেন্দ্র চলাচল করে। চাঁদা না দিয়ে কেউ গাড়ি চালাতে পারে না। নামে-বেনামে বিভিন্ন সংগঠনের লোকজন টোকেনের মাধ্যমে চাঁদাবাজি করত। একই দিন চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে সবজি ও পণ্যবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজির সময় পাঁচটি পয়েন্ট থেকে ৩০ জন চাঁদাবাজকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করেছের্ যাব। নগরীর ৫০টি পয়েন্টে চাঁদাবাজি হয় বলে সূত্রটি জানিয়েছে। অন্য স্পটগুলোতে চাঁদাবাজি করাদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত আছে।
র্
যাব মহাপরিচালক পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, দ্রব্যমূল্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখতে পণ্যবাহী যানবাহনে চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে র?্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানও চলবে। সামনের দিনগুলোতে অভিযানের সংখ্যা ও তীব্রতা আরও বাড়ানো হবে।
তবে সরেজমিনে বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, চাঁদাবাজ, মুনাফাখোর ও সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলমান থাকলেও, নিত্যপণ্যের দামে তেমন কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি। বাজার ভেদে সবজি ও নিত্যপণ্যের দাম কেজি প্রতি ৫ থেকে ১০ টাকা কমেছে। গত সপ্তাহে পেঁয়াজের দাম ছিল কেজি প্রতি ৯০ টাকা। বর্তমানে প্রতি কেজি দেশি মুরিকাটা পিয়াস বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকায়। বেগুনের দাম কেজি প্রতি বাজার ভেদে ১০ টাকা কমে ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মুলা বিক্রি হচ্ছে ১০ টাকা কমে কেজি প্রতি ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। তবে সবজির মধ্যে লাউয়ের দাম ঊর্ধ্বমুখী। মাঝারি আকারের প্রতিটি লাউ বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১০০ টাকায়। গত সপ্তাহেও প্রতিটি লাউ ছিল ৮০ টাকা। ডিমের দাম ডজন প্রতি ৫ টাকা উঠানামা করছে। বর্তমানে প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৩০ থেকে ১৩৫ টাকায়। বাজার ভেদে প্রতি ডজন ডিম আবার ১২৫ থেকে ১৩০ টাকায়ও বিক্রি হতে দেখা গেছে।